একাত্তরের দিনগুলি’-তে শরীফ ইমাম


আমরা যাঁরা বর্ডার ক্রস করে যুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি, তাঁদের কিন্তু দেশে বসেও অনেক কিছু করার আছে।’—শরীফ ইমাম।
শুধু এই মৌখিক উক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে শরীফ ইমাম ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলোতে দেশে বসেই তাঁর কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করেন।
প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বিনয়ী, মৃদুভাষী ও অমায়িক চরিত্রের অধিকারী শরীফ ইমামের কঠিন দেশপ্রেম প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে একাত্তরে অগ্নিঝরা দিনগুলোতে।
জাহানারা ইমামের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা ‘একাত্তরের দিনগুলি’-তে প্রকাশ পেয়েছে স্বামী শরীফ ইমামের দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধে অবদান, প্রখর ব্যক্তিত্ব, নির্ভীক মানসিকতা, মুক্তিযোদ্ধা পুত্র শহীদ রুমীর জন্য তীব্র ভালোবাসা।
জাহানারা ইমাম তাঁর স্মৃতিকথায় স্পষ্ট তুলে ধরেছেন শরীফ ইমামের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা প্রদানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার বিষয়গুলো। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চলাচল ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ তাঁর কাছে বাংলাদেশের ব্রিজ ও কালভার্টের তালিকা চেয়ে পাঠান। সারা দেশের সবগুলো ব্রিজ আর কালভার্টের তালিকা তৈরি করা সহজসাধ্য ছিল না। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাঁকে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করতে হয়েছিল। রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজের ডিজাইন ডিভিশনে অবাঙালি এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার কর্মরত থাকায় সেখান থেকে ব্রিজের ফাইলগুলো বের করে আনা ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ। সুকৌশলে ফাইলগুলো সরানোর পর শরীফ ইমাম একপ্রকার আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করে লাগাতার তিন দিন ধরে ৩,৫০০টি ব্রিজ আর কালভার্টের তালিকা তৈরি করেন সহকর্মী এস আর খান বাঁকা এবং সামাদ সাহেবকে নিয়ে। সামাদ সাহেবের বাসায় বসে এস আর খান বাঁকা নিজের হাতে ফাইল থেকে তালিকা কপি করেন এবং শরীফ ইমাম বিভিন্ন ধরনের ব্রিজের ড্রয়িং থেকে প্রতিটির স্পেসিফিকেশন লেখেন। তাঁদের দুজনের হাতের লেখা যাতে চেনা না যায়, সে জন্য দুজনের হাতের লেখা অংশগুলো অন্য একজনকে দিয়ে আবার কপি করানো হয়। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ সম্পন্ন করে শরীফ ইমাম মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়ার জন্য তৈরি করা তালিকা এবং ড্রয়িং বাড়ি নিয়ে আসেন। ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের অফিসের ওপর আইবির নজরদারি থাকায় শরীফ ইমাম মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী আর হাবিবুল আলমকে তাঁর বাসা থেকে তালিকাগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন।
শরীফ ইমামের বাসভবন ‘কণিকা’ ১৯৭১ সালে গেরিলাযোদ্ধাদের পদচারণে মুখর ছিল। মুক্তিযোদ্ধা-পুত্র রুমীর সহযোদ্ধারা নিরিবিলিতে অপারেশনের প্ল্যান করার জন্য কণিকাতে এলে শরীফ ইমাম নিজে বাজার করে গেরিলাযোদ্ধাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। ২৫ আগস্ট ’৭১-এ ধানমন্ডিতে দুর্ধর্ষ অপারেশন সেরে আসা রুমী এবং তাঁর দলের অস্ত্রশস্ত্র নিজ বাসভবনে লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে শরীফ ইমাম সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া শরীফ ইমাম এবং জাহানারা ইমাম মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁদের সাধ্যমতো আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করতে থাকেন। কিন্তু তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা-পয়সা না থাকায় শরীফ ইমাম তাঁর অন্য বন্ধু এবং সহকর্মীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব নেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, পাকিস্তান কনসালট্যান্টসের ডিরেক্টর মজিদ সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার জন্য ১০ হাজার টাকা শরীফ ইমামকে প্রদান করলে তিনি ওই টাকা ক্রমান্বয়ে কিছু কিছু করে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট আনুমানিক রাত ১২টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শরীফ ইমামকে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা-পুত্র রুমী, কনিষ্ঠ পুত্র জামী, রুমীর বন্ধু ও চাচাতো ভাইকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং দুই দিন অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শেষে রুমী ছাড়া তাঁকে এবং অন্যদের ছেড়ে দেয়। বন্দিশিবিরে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো নির্ভীক শরীফ ইমামের কাছ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী কোনো তথ্য বের করতে পারেনি। রুমীকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি সেনা অফিসারের সব প্রশ্নের অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে তিনি উত্তর দেন। এই পরিস্থিতিতেও একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে তিনি প্রশ্নকারী অফিসারকে পাল্টা প্রশ্ন করেন। এতে ওই অফিসার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন।
পাকিস্তানি সেনাদের বন্দিশিবির থেকে ফিরে আসার পর শরীফ ইমাম স্ত্রীকে সেখানকার অমানুষিক নির্যাতনের বিষয়ে কিছু জানতে না দিয়ে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু শরীফ ইমামের ভ্রাতুষ্পুত্রের কাছ থেকে জাহানারা ইমাম সবকিছু জেনে যাওয়ার পর শরীফ ইমামের স্বীকার করা ছাড়া উপায় ছিল না।
জাহানারা ইমাম তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’-তে উল্লেখ করেন যে, তিনি জীবনে কখনো শরীফ ইমামকে কাঁদতে দেখেননি। এই প্রথম শরীফ ইমাম রুমীর নাম করে কাঁদলেন। বাইরে কঠোর মনোভাব বজায় রাখলেও ভেতরে-ভেতরে পুত্রশোকে শরীফ ইমাম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। রুমীকে উদ্ধার করার জন্য শরীফ ইমামের শুভানুধ্যায়ীরা মার্সি পিটিশন করার কথা বললেও প্রখর ব্যক্তিসম্পন্ন শরীফ ইমাম তাতে রাজি হননি। যদিও তিনি জানতেন এর পরিণতি কী হতে পারে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন রুমীকে বের করে আনার যত চেষ্টা আছে তিনি করবেন। কিন্তু মার্সি পিটিশন করে নয়। কেননা, যে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রুমী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, তাদের কাছে মার্সি পিটিশন করলে রুমীর আদর্শকে হেয় করা হবে। তাই প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শরীফ ইমাম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও পুত্রের জীবনের চাইতে তিনি দেশ এবং পুত্রের আত্মসম্মানকেই প্রাধান্য দেন। রুমীর আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তিনি নতিস্বীকার করেননি সামরিক জান্তাদের কাছে। ফলে শহীদের তালিকায় লিপিবদ্ধ হয় রুমীর নাম। পুত্রশোক ও চরম অত্যাচার-অপমানের বোঝা একপর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে বিজয়ের মাত্র তিন দিন আগে মৃত্যুবরণ করেন শরীফ ইমাম।
মুক্তিযুদ্ধের এই মহান নেপথ্য নায়কের ৮৮তম জন্মবার্ষিকীতে বাঙালি জাতি তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।
আবিদ হোসেন: সহযোগী তত্ত্বাবধায়ক, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর।
আরও পড়ুন
একাত্তরের দিনগুলি  জননী জাহানারা ইমাম

মন্তব্যসমূহ