দুর্বৃত্তরা আপনার বা আমার মোবাইল ফোনের সিম ক্লোন করে অপরাধমূলক কাজে যোগাযোগের জন্য সেটিকে ব্যবহার করলে আপনাকে বা আমাকে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হবে। যদি ক্লোনিং সম্ভব হয়, যদি এর প্রসার ঘটে, তবে তা বড় মাপের সামাজিক বিপর্যয়ও তৈরি করবে। অসুবিধায় পড়তে হবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকেও। আশার কথা হচ্ছে, ক্লোনিং অত্যন্ত দুরূহ কাজ। কারও কারও মতে, এটি অসম্ভব। তবুও কথা যখন উঠেছে, তখন বলতেই হয়, ক্লোনিং প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা, যদি থাকে, অবলম্বন করা নিজের ভালর জন্য যেমন দরকার, তেমনই নাগরিক হিসেবে আমাদের কর্তব্যও বটে; এতে দুর্বৃত্তদের নিরাপদ যোগাযোগ ব্যাহত হবে, তাদেরকে চিহ্নিত করাটা কর্তৃপক্ষের জন্য সহজ হবে।
সিম ক্লোনিং ব্যাপারটা প্রথমে নজরে আসে একটি দেশীয় পত্রিকা থেকে। পত্রিকায় যা লেখা হয়েছে তা পড়ে আমার মনে হয়েছে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা যেকোনো নিরীহ মানুষের মনেই শঙ্কা উদ্রেক করতে পারে। আমিও যেহেতু নিরীহ মানুষ, সেহেতু শঙ্কা আমার মনেও এসে ঠেকেছে। আর কেউ মানুক আর নাই মানুক, প্রকৃত কথা হচ্ছে, এক নিরীহ মানুষই অন্তর দিয়ে অনুভব করে আরেক নিরীহ মানুষের বিড়ম্বনার যাতনা। ফলে বিষয়টা ব্লগে পাড়া সময়োচিত কাজ বলে মনে হয়েছে।
পত্রিকায় পড়ার পর সিম ক্লোনিং নিয়ে ইন্টারনেট খুঁজে বাংলা ভাষায় লেখা বেশ কিছু আর্টিক্যাল পড়ে দেখেছি। বিভিন্ন লেখক; কিন্তু কেউই ক্লোনিংয়ের সম্ভবপরতাকে একেবারে উড়িয়ে দেননি। তবে তাদের কেউ কেউ এও বলেছেন যে, এ নিয়ে একটা মহা তোলপাড় বাঁধানোরও কিছু নেই। আমার ব্যক্তিগত ধারণা হয়েছে, ক্লোনিংয়ের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে যত কমই হোক, কারও জন্য তা বাস্তব হয়ে দাঁড়ালে তো সমস্যা গুরুতর হয়ে উঠবে। তাই সতর্কতা অবলম্বন ভাল; নিজের জন্যও এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর জন্যও এটা সহায়ক হবে।
সবকটি আর্টিক্যালেই এ বিষয়ে কয়েকটি অভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। লেখকদের মতে, কল রিসিভ করলে রেসিপিয়েন্টের সিমকার্ডে নিহিত তথ্যাদি অন্য প্রান্ত থেকে চুরি করা সম্ভব নয়। দুর্বৃত্তরা এজন্য কলব্যাকের প্রত্যাশায় মিসড কল দিয়ে থাকে। কাজেই অপরিচিত নম্বর থেকে মিসড কলের বিপরীতে কলব্যাক না করা হলে ক্লোনিংয়ের শিকার হওয়া থেকে বাঁচা যাবে। এই বিরত থাকাটা দাফতরিক বা ব্যবসায়িক কাজের ধরণের কারণে অনেকের জন্যই কঠিন বা সমস্যাপূর্ণ। তবে আমারা যারা সীমিত পরিসর জীবনের অধিকারী তারা পরামর্শটা গ্রহণ করতে পারি। সো নো কলব্যাক এগেইনস্ট মিসড কল ফ্রম আননোন নাম্বার। সরি, মোবাইল ফোন অপারেটরস, ফর পসেবল রেভিনিউ রিডাকশন।
মোবাইল ফোন নিয়ে কথা যখন উঠলোই তখন গ্রামীণ ফোনের গ্রাহক হিসেবে আমার একটি অবসারভেশন শেয়ার করতে ইচ্ছা হলো। আগেই বলে রাখি, নতুন জিনিসকে, নতুন সিস্টেমকে আমরা সাধারণত ভয় পাই। একইভাবে, প্রথম ব্র্যান্ড প্রথম প্রেমের মতোই মনের ভেতর লটকে থাকে। সুইচ করার ক্ষেত্রে আমরা তাই একধরণের স্থিতি-জড়তায় ভুগি। আজও আমি টিভি সেট বা গানের কল বলতে সনি বুঝে থাকি। ল্যাপটপ বলতে বুঝি ডেল। একই নিয়মে, কেউ মোবাইল ফোন নিয়ে কথা বললে আমার ধারণা হয়, গ্রামীণ ফোন নিয়ে বুঝি কথা হচ্ছে। আমার পরিবারের সবকটি সিমই গ্রামীণ ফোনের। কাজেই হেন গ্রাহকের অবসারভেশনে প্রমাদ থাকলে ক্ষমা করা হবে আশা করছি।
ব্যাপারটা হচ্ছে মোটে তিরিশ টাকার। তবে এটা দশ টাকার সমস্যাও হতে পারে, হতে পারে একশ টাকারও। আমি গরীব মানুষ; ভুগেছি দশ টাকা, তিরিশ টাকার সমস্যায়। কথা বলতে বলতে টাকা ফুরিয়ে গেল। বা কল করার জন্য পর্যাপ্ত টাকা আর নেই—এমন অবস্থায় পড়া গেল। ফ্লেক্সির জন্য যে অনুরোধ করবো তারও উপায় থাকে না। এরকম অবস্থায় আমার ফোন কোম্পানি আমাকে সব বারই, বিনা ব্যতিক্রমে, নারীকণ্ঠে জানান দেয় (পুরুষকণ্ঠকে তারা কেন এতো না-পছন্দ করে থাকে—সে আরেক রহস্য), তারা আমাকে তিরিশ টাকা ধার দিতে প্রস্তুত। এটিকে তারা ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স বলে থাকেন।
আমার অবসারভেশন মতে, এটা একটা অদ্ভুত কর্জ, শুভঙ্করী কর্জ। কী করে এটা শেষ বিচারে ব্যালেন্স পদবাচ্য হয় তা আমার বোধগম্য হয়নি। ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স নামে আপনি দশ, তিরিশ, একশ টাকা কর্জ হিসেবে পাবেন, বা পেয়ে থাকেন। এবং এ থেকে যা-ই খরচ করেন না কেন, রিফিল করার সময় পুরো তিরিশ ইত্যাদি টাকাই মাইনাস হয়। এবং একইসাথে আগের সেই তিরিশ ইত্যাদি টাকার মধ্যকার যত টাকাই খরচার বাইরে থাকুক না কেন—সেটাও গায়েব হয়। আপনি সুপরামর্শ হিসেবে বলতেই পারেন, “ভাই! এতোই যদি টাকার মায়া, তবে সেই তিরিশ টাকা শেষ না হওয়া তক কথা বলে নিলেই হয়।” মধুনিষ্যন্দী কণ্ঠের ধ্বনী-স্রোতে বারবার ভাসার মাঝে সুখ থাকতে পারে, কিন্তু এতে তো ‘আপনার একাউন্টে কল করার জন্য পর্যাপ্ত টাকা নেই’ সমস্যাটি কর্পূর হয়ে যায় না।
আমি যে বার-কতক এটা এভেইল করেছি তাতে প্রতিবারই আমার একটাই কল হয়েছে ও তাতে দু’টাকার বেশী খরচ না হওয়ারই কথা। সে অবস্থায় আমার একমাত্র কল আমার অফিস সহকারীকে ফ্লেক্সির অনুরোধ করার জন্য মাত্র। আপনি হয়তো এখন এও বলতে পারেন, “ভাই! মোটে তিরিশ টাকার ব্যাপার; এ নিয়ে হৈচৈয়ের কী আছে? আফটার অল, জেন্টেলম্যানস লোন। মহাজনী সুদের কারবার তো নয়।” আপনার কথা ঠিক বটে। কিন্তু এ নিয়ে আমি কী বলতে চাই—সেটা বুঝানোর জন্য আলিফ লায়লার গল্পের মতো করে মাঝখানে আরেক ঘটনার কথা ফাঁদতে হয়।
বহুবছর আগের কথা। মিনিবাসের ভাড়া বাড়লো। আমি যেখান থেকে বাসে উঠি সেখান থেকে ফার্মগেট চার টাকা ভাড়া হলো। আর ফার্মগেট থেকে শাহবাগ দু’টাকা। মোট ভাড়া দাঁড়ালো ছ’টাকা। আবার একটানে গেলেও সেই ছ’টাকাই। না ভাই, এ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। সমস্যা বাঁধলো যখন ফার্মগেটের যাত্রীরা ইট ছুড়ে কাঁচ ভেঙে দু’টাকাকে দেড় টাকায় নামিয়ে আনলো। আমি ফার্মগেটের ভাড়া দিলাম। ফার্মগেট পার হলে পর দিলাম দেড় টাকা—একটা ভেজাল বাঁধানোর মতলবে আধুলিটা আগেই জোগাড় করে রেখেছিলাম। উৎকোচের নোটের যেমন ভাংতি হয় না, তেমনই পাওনাদারের হিসেবে না মিললে আধুলিরও আশা থাকে না। কিন্তু কন্ডাকটর ভাই সহজে ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। তার যুক্তিমূলক উক্তি: “ভাই! আপনে তো একটানে আইসেন; আপনের ভাড়া ছয় টেকা।” তারপর কথার পিঠে কথা। একসময় তিনি আরও বললেন, “আপনে যদি ফার্মগেট নাইম্মা আবার গাড়িতে উঠতেন, তাইলে দেড় টেকা মাইন্না লওন যাইতো।”
কিন্তু এই নামা-উঠায় তার কী লাভ, আর সিটে বসে থাকায় তার কী ক্ষতি, তা সহযাত্রীদেরও বোধগম্য হয়নি। কিন্তু নাছোড়বান্দা ভাইয়ের সাথে তর্ক বেড়েই চলছিল বলে একজন বললেন, “ভাই! মোটে তো আটআনা; এর জন্য এতো ঝামেলা করে কী লাভ?” আমি ততক্ষণে অনেকটাই কাহিল। কিন্তু জোরের সাথেই বললাম, “এটা আটআনার বিষয় নয়, মানুষের যুক্তিবুদ্ধির বিষয়; যুক্তিবোধটাই যদি ভেঙে পড়ে তবে সেটাকে কি আটআনার ক্ষতি বলে মনে হবে?” এতো বিভীষণ কথায় আমার মঙ্গলকামী সহযাত্রী ভাই গোলগোল চেখে তাকালেও কথা আর বাড়াননি। আমিও আটআনা ফেরত নিয়ে একটাকা দিলাম। সে আধুলিটি বা অন্য কোনো আধুলি পরে আমি আর এই সওদা করতে ব্যবহার করিনি। কাজেই বুঝতেই পারছেন, আমার পেয়ারের ফোন কোম্পানির সাথে আমার ঝামেলার একটা ঠিক কোথায়।
হোক না তিরিশ টাকা মাত্র। কিন্তু বাকীটা যত কমই হোক, তা খেয়ে ফেলার জন্য এতো বড় কোম্পানির কী ঠেকা পড়েছে কে জানে। আর আমি তো নির্দ্বিধায় দাবী করতেই পারি, আমি এই কোম্পানির তুলনায় একটু হলেও বেশী গরীব—এজন্য কেউই বোধ হয় আমার উপর মিছে কথা বলার দায় আরোপ করবেন না। আমার এক বন্ধু আছেন; কেউ এসে যদি বলেন, যাওয়ার ভাড়া নেই, টাকা-পয়সা সব পকেটমার নিয়ে গিয়েছে ইত্যাদি, তবে শ-পাঁচেক টাকা পর্যন্ত দিতে দেখেছি। যতই বলা হয়, এসব লোকটার মিছে কথা, ততই তিনি বলেন, “তো কী হয়েছে? তার তো টাকা-পয়সার অভাব আছে, না থাকলে এভাবে মিছে কথা বলতে যাবে কেন?” কিন্তু শুভঙ্করী কর্জ দানে ফোন কোম্পানির অভাবটা ঠিক কোথায় তা গবেষণার বিষয় বটে।
- See more at: http://blog.bdnews24.com/abdulmonem/177918#sthash.6M6E3udO.dpuf
মন্তব্যসমূহ