বাস্তব জীবনে যেমন ছিলেন প্রিয় অভিনেত্রী দিতি



diti-family
বিনোদন ডেস্ক – পারভিন সুলতানা দিতি আশির দশকের শেষের দিক আর নব্বইয়ের শুরুতে ঢাকাইয়া সিনেমার শুধু পরিচিত মুখই ছিলেন না,বলা চলে ঢালিউড সে সময় শাবানা ও দিতির উপর নির্ভর ছিল। আর শাবানা মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে গেলে পুরো নির্ভর হয়ে পড়ে দিতির উপর। তবে সে যাত্রায় খৈ হারিয়ে ফেলেন দিতি। একসময় দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান সুদূরে।
 
পারভিন সুলতানা দিতি। অসম্ভব সুন্দর এই অভিনেত্রী এর জন্ম ১৯৬৫ সালে নারায়নগঞ্জ এ।তিনি লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে বি.এ. সম্পন্ন করেন। উনি মিডিয়া জগৎ এ প্রথম পা রাখেন বিটিভি তে গান গাওয়ার মাধ্যমে।
বাংলাদেশের অভিনয় জগতের বরেণ্য এ চিত্রনায়িকা ১৯৮৪ সালে নতুন মুখের সন্ধানের মাধ্যমে দেশীয় চলচ্চিত্রে সম্পৃক্ততা পদার্পন করেন।
তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র উদয়ন চৌধুরী পরিচালিত ‘ডাক দিয়ে যাই’। কিন্তু ছবিটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। দিতি অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘আমিই ওস্তাদ’। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন আজমল হুদা মিঠু।
১৯৮৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ও আজমল হুদা মিঠু নির্মিত আমিই ওস্তাদ চলচ্চিত্রটিই বলা যেতে পারে দিতি অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র। ১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ও আমজাদ হোসেন নির্মিত হীরামতি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রিয় শত্রু চলচ্চিত্রে তিনি পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা প্রসেনজিৎ এর সাথে অভিনয় করে দারুন আলোচিত হন। ১৯৮৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ও আব্দুল্লাহ আল মামুন নির্মিত দুই জীবন চলচ্চিত্রটি উনার জন্য মাইলফলক। এই চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত দুটি গান আজও মানুষের মুখে ফেরে। ” তুমি আজ কথা দিয়েছো বলেছো দুটি মন ঘর বাধবে” এবং ” তোমায় একদিন আমি না দেখিলে তোমার মুখের কথা না শুনিলে ” ।
এরপর দিতি প্রায় দুই শতাধিক ছবিতে কাজ করেছেন। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘স্বামী স্ত্রী’ছবিতে তিনি আলমগীরের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন। এই ছবিতেই অভিনয় করে দিতি প্রথম বারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে- হীরামতি, দুই জীবন, ভাই বন্ধু, উসিলা, লেডি ইন্সপেক্টর, খুনের বদলা, আজকের হাঙ্গামা, শেষ উপহার, চরম আঘাত, অপরাধী, কালিয়া, আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা প্রভৃতি। দিতি অসুস্থ হওয়ার আগে সর্বশেষ অভিনয় করেছেন রেদওয়ান রনির ‘আইসক্রিম’ছবিতে। যা মুক্তি পাচ্ছে ২৯ এপ্রিল।
গেল ক’বছর দিতি ছোট পর্দায়ও নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। একক ও ধারাবাহিক নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন। সঙ্গে রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থাপনাও করেছেন সাফল্যের সঙ্গে।
সংসার জীবনে দিতি
সিনেমায় দিতি সবচেয়ে বেশিসংখ্যক জুটি আবদ্ধ হয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে। এ জুটির প্রাণবন্ত অভিনয় গোগ্রাসে দর্শকরা গিলে ফেললেও বাস্তব জীবনে প্রাণবন্ত হতে পারেনি এ জুটির সংসার। দুজনেরই ছিল দ্বিতীয় বিয়ে।  প্রথম স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন এক সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর পর  পারভীন সুলতানা দিতিকে বিয়ে করেন ইলিয়াস কাঞ্চন । তবে, ডিভোর্সেই পরিসমাপ্তি ঘটে কাঞ্চন-দিতির সংসার।
ymHy8ooZqd8Q
তার আগে দিতি প্রথম বিয়ে করেছিলেন ১৯৮৬ সালে। বর চলচ্চিত্রেরই মানুষ সোহেল চৌধুরী। নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রম দিয়ে দিতির সঙ্গে একই সময়ে পা বাড়ান এ জগতে। চলচ্চিত্রে আসার পর প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক এফ কবীর চৌধুরী সোহেল চৌধুরীকে ‘পর্বত’ নামের ছবিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন।
ওই ছবিতে তার বিপরীতে নায়িকা ছিলেন দিতি। দুজনের অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল। এর পরের বছর ১৯৮৫ সালে আমজাদ হোসেনের ‘হীরামতি’ ছবিতে অভিনয় করেন সোহেল। এই ছবিতেও তার নায়িকা দিতি। এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই প্রেমে পড়েন দুজন। এরপর বিয়ের বন্ধনে বাধা পড়েন।
জীবনের শেষ দিনগুলো
গত বছরের ২৬ জুলাই মস্তিষ্কে টিউমার ধরা পড়ায় ভারতে চেন্নাইয়ের মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব অর্থোপেডিকস অ্যান্ড ট্রামাটোলজিতে (এমআইওটি) ভর্তি হয়েছিলেন দিতি। ছায়ার মতো সঙ্গে ছিলেন ছেলে লামিয়া ও দীপ্ত। হাসপাতালে শুরু হলো দিতির জীবনের নতুন এক অধ্যায়। রুটিন ধরে ধরে চলতো কেমোথেরাপি। কেমো বড্ড যন্ত্রণা দিত তাকে। কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় একসময় তার দীঘল কালো চুলগুলো ঝরা শুরু হয়। চুলগুলো না ফেলে পরম যত্নে ব্যাগে পুরেছিলেন দিতি। সেগুলো দিয়ে দুটো উইগ বানাতে চেয়েছিলেন।
দিতির মেয়ে লামিয়া চৌধুরী ফেসবুকে জানিয়েছিলেন,  ‘চুল যখন ঝরে পড়তে শুরু করলো , তখন তিনি সেগুলো একটি ব্যাগে জমাতে শুরু করলেন। চুল নিয়ে তার কোন চিন্তায় ছিলোনা। চিকিৎসকরা মাঝে মধ্যে চমকে যেতেন।’
হাসপাতালটাকে তখন খুব একঘেয়ে লাগতো তার। চার দেয়ালে বন্দি চড়ুই পাখির মতো ছটফট করতেন। ডাক্তারদের কাঁচির নিচে নিজেকে সঁপে দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। মাথায় ছিলো কাঁটাছেড়ার দগদগে দাগ। দাগটা মাথা থেকে বাসা বেঁধেছিল মনেও। পড়ন্ত বিকেলে ছেলে-মেয়ের কাঁধে ভর দিয়ে বিছানা ছেড়ে হাসপাতালে ব্যালকনিতে দাড়াতেন। ব্যালকনিটা ছিলো তার কাছে কাঁটাতার। এর বাইরে যাওয়ার শক্তি কিংবা সামর্থ্য কোনটায় নেই। সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলেন। এক পা দু’পা করে নিজে নিজেই হাঁটতে পারতেন। ছেলে-মেয়েরা তো আনন্দে আটখানা। শরীরে বল পাচ্ছেন দিতি। উন্নতি হলো শরীরের। অনেকটা সুস্থ হওয়ার পর মাসখানেক পারে ডাক্তারি নির্দেশনায় ঢাকায় আনা হয় তাকে। বিশ্রামে ছিলেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে কথাও বলেছেন তখন।
২৯ জুলাই প্রথম অস্ত্রোপচারের পর কেমো নিয়ে ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরেন জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী।
কিন্তু কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ কারণে ৩০ অক্টোবর তাকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে।
অবস্থা অপরিবর্তিত থাকার কারণে গত বছরের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় দিতিকে চেন্নাই নেওয়া হয়। এর দু’দিনের মাথায় ৫ নভেম্বর তার মস্তিষ্কে দ্বিতীয়বারের মতো সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মস্তিষ্কে জমে থাকা পানি অপসারণ করা হয়। কিন্তু তখনও পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত ছিলেন না। তার অবস্থা এতোই গুরুতর ছিলো যে, মাসখানেক নিজের দুই সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের চিনতে পারছিলেন না তিনি।
সর্বশেষ আজ রবিবার বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দিতি। দিতি বেশ কিছুদিন ধরে এখানে কোমায় ছিলেন। তার মৃত্যুতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তিনি এক কন্যা (লামিয়া চৌধুরী) ও এক পুত্র দীপ্ত এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
স্মৃতির ধুলোমাখা ডাইরির পাতা থেকে দিতি
দীর্ঘ সময়ে তিনি নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন দিতি । তবে সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে জীবনের সুন্দর কিছু সময় কাটিয়েছেন তিনি ।  ‘৯৮ সালে স্বামী সোহেলকে হারানোর পর দুজন সন্তানকে মানুষ করতেই দিতির সারাবেলা কেটে যেত। এরপর দুই সন্তানকে উচ্চ শিক্ষার জন্য কানাডায় পাঠান দিতি।
দুবছর আগেই একটি পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘ সন্তানদের দেখতে প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট সময়ে কানাডা যেতাম । দেশে ফিরে আর কাজে মন বসাতে পাআরতামনা  মনটা ছেলে-মেয়েদের কাছেই পড়ে থাকে। অতীত জীবনের গল্প বলতে গিয়ে দিতি বলেন, অভিনেতা আল মনসুরের কারণেই তিনি আজ দিতি হতে পেরেছেন। তিনিই তাকে প্রথমবার নাটকে অভিনয়ের সুযোগ দিয়েছিলেন। খুব ছোটবেলায়ই দিতি গানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। শৈশবে শিশু একাডেমী আয়োজিত প্রতিযোগিতায় জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হন। যে কারণে নায়িকা হওয়ারও অনেক আগে তার গায়িকা হওয়ার ইচ্ছা ছিল। বিটিভিতে একদিন গান করার সময় তিনি আল মনসুরের নজরে আসেন। তিনি দিতিকে খুঁজে বের করে মানস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘লাইলি মজনু’ নাটকে কাস্ট করেন। নাটকটি প্রচারের পর দর্শক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। কিন্তু দিতির অভিনয় চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পরিবার থেকে বাধা আসে। বেশ কিছু দিন বিরতি নিয়ে আবারো ফখরুল আবেদীনের প্রযোজনায় ‘ইমিটেশন’ নাটকে তিনি অভিনয় করেন। এর পরই চলচ্চিত্রে কাজ করার ব্যাপারে তার কাছে প্রচুর অফার আসতে থাকে। তবে দিতি ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে নেন। তার অভিনীত প্রথম ছবি ছিল প্রয়াত পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘ডাক দিয়ে যাই’। এ ছবিতে তার নায়ক ছিলেন আফজাল হোসেন। কিন্তু আশি শতাংশ কাজ শেষ করার পরও ছবিটি আলোর মুখ দেখেনি। দিতির মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি প্রয়াত পরিচালক আজমল হুদা মিঠুর ‘আমিই ওস্তাদ’। এ ছবিতে দিতির অনবদ্য অভিনয় দর্শকের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। এরপর আর দিতিকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে দিতি সবচেয়ে বেশি জুটিবদ্ধ হয়ে অভিনয় করেছেন।
এ প্রসঙ্গে দিতি বলেন, সত্যি বলতে কি, কাঞ্চন সাহেব অনেক গুণী একজন অভিনেতা। তার সঙ্গেই আমি সবচেয়ে বেশি ছবিতে অভিনয় করেছি। পর্দায় আমাদের অভিনয় ছিল প্রাণবন্ত। যে কারণে দর্শকও আমাদের ছবিগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখতেন। তবে সোহেল যদি চাইত কিংবা সিরিয়াস হতো তাহলে চলচ্চিত্রে আমাদের জুটিই হতো সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। কারণ আমাদের দুজনকে জুটি হিসেবে দারুণ মানাত।
দিতি ওপার বাংলার জনপ্রিয় নায়ক প্রসেনজিতের সঙ্গে ‘প্রিয় শত্রু’ ছবিতেও অভিনয় করেছেন। ছবির ‘চিঠি কেন আসে না আর দেরি সহে না’ শিরোনামের গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
প্রয়াত পরিচালক সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘স্বামী স্ত্রী’ ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে দিতি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে দিতি বলেন, সত্যি বলতে কি, অভিনয় করে দর্শকের যে ভালোবাসা পেয়েছি তার চেয়ে বড় পুরস্কার আর নেই। দর্শকের ভালোবাসাই আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা। আর সন্তানরা আমার ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার দুর্নিবার সাহস।
আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে অনুপম রেকর্ডিং মিডিয়ার ব্যানারে দিতির প্রথম একক অ্যালবাম ‘তোমার ও চোখে’ বাজারে আসে। এরপর মাঝে দু-একটি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করলেও দীর্ঘদিন আর কোনো অ্যালবাম প্রকাশ করেননি তিনি। অবশেষে ২০১১ সালে লেজার ভিশনের ব্যানারে বাজারে আসে তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ফিরে যেন আসি’। এটিও বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
-

মন্তব্যসমূহ