মো. ইমদাদুল হক শিপন (২২) হত্যা মামলায় তার কথিত প্রেমিকা ফাতেমা আক্তার সোনালীকে (২১) ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছেন আদালত। শিপন খুলনা মহানগরীর খানজাহান আলী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ের মেডিকেল ইনস্টিটিউটের প্যাথলজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মামলায় অভিযুক্ত অপর এক আসামি সোনালীর সহযোগী মেহেদী হাসান অনিক ওরফে অনিকে (২১) বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে।
সোমবার দুপুরে খুলনার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মোসাম্মাৎ দিলরুবা সুলতানা এ রায় ঘোষণা করেছেন। রায় ঘোষণার সময় দু’জন আসামিই আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পর আদালতের নির্দেশে সোনালীকে জেলা কারাগারে ও অনিককে মুক্ত করা হয়।
সোনালী হরিণটানা থানাধীন জয়খালী কৈয়া বাজার এলাকার মৃত খবির গাজীর মেয়ে। আর অনিক জেলা পুলিশ লাইন পূর্ব গলির সাবেক এমপি সৈয়দা নার্গিস আলীর ১০/২নং বাড়ির ভাড়াটিয়া শেখ মহিউদ্দিনের ছেলে। তার গ্রাম বাগেরহাট জেলার দেপাড়া শেখবাড়ি।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকে জানা গেছে, নিহত মো. ইমদাদুল হক শিপন নগরীর জোড়াগেট আবাসিক এলাকার এসডি কলোনির তৃতীয় তলা ভবরের নিচ তলায় তার মামা গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তা মো. আবু বক্করের বাড়িতে বসবাস করতেন। গত ২০১৪ সালের ৬ মার্চ এসডি আবু বক্কর স্বপরিবারে তিনদিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি মাগুরায় যান। এসময় তিনি ওই বাসায় তার ভাগ্নে শিপনকে রেখে যান।
এর তিনদিন পর অর্থাৎ ৯ মার্চ সকালে ওই ঘর থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের লোকজন টেনে জানালা খুলে। ভেতরে তারা বিভৎস অবস্তায় খাটের ওপরে শিপনের লাশ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেয়। সংবাদ পেয়ে সোনাডাঙ্গা মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে দরজা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে লাশ উদ্ধার করে। শিপনের গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল এবং ও পাশে তার কলিজা বের করে রাখা অবস্থায় পাওয়া যায়। হত্যার পর শিপনের ব্যবহৃত ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায় খুনিরা।
এ ঘটনায় নিহতের ভাই মো. বাবুল মিয়া বাদী হয়ে সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় অজ্ঞাত আসামিদের নামে মামলা করেন (যার নং ০৭)। সোনাডাঙ্গা মডেল থানা পুলিশ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সোনালী ও অনিককে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেন। এরপর মহানগর হাকিম আয়েশা আক্তার মৌসুমীর আদালতে আসামি সোনালী হত্যাকাণ্ডের বিররণ জানিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
আদালতে দেয়া সোনালীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি ও পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে সোনালীর মা নুরজাহান বেগম অসুস্থ হয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় তলায় সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন। এসময় মায়ের দেখাশুনার জন্য নিয়োজিত সোনালী হাসপাতালের লিফ্ট ব্যবহার করার সময় শিপনের সাথে পরিচয় হয়। একপর্যায়ে তারা একে অপরকে ভালোবাসতে শুরু করেন।
মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা গরীব পরিবারের মেয়ে সোনালী যখন জানতে পারে তার প্রেমিক শিপনের আরো ৪/৫টি প্রেমিকা আছে যাদের সাথে তার দৈহিক সম্পর্কও রয়েছে। মনে মনে ক্ষুব্দ হয় সে।
এদিকে সোনালী সাবেক মহিলা এমপি সৈয়দা নার্গিস আলীর বাসায় কাজ করার সুবাদে ওই বাসার ভাড়াটিয়ার ছেলে অনিকের সাথে তার পরিচয় ছিল। সে অনিকের সহায়তায় বাজার থেকে একটি ছুরি ও ২০টি ঘুমের ট্যাবলেট কিনে আনে।
এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৪ সালের ৮ মার্চ দুপুর দেড়টার দিকে জোড়াগেট আবাসিক এলাকার এসডি কলোনির তৃতীয় তলা ভবনের নিচ তলার শিপনের মামার বাসায় যায় সোনলী। সেখানে গিয়ে শিপনকে ঘুমের ওষুধ মেশানো আরসি কোলা খাওয়ায়। ওষুধ মিশ্রিত আরসি কোলা খেয়ে শিপন খাটের ওপরে শুয়ে পড়ে। এ সুযোগে সোনালী রশি দিয়ে তার হাত-পা বেঁধে গলায় ছুরি দিয়ে পোচ দেয়। এতে জেগে ওঠে শিপন।
তখন শিপন তার প্রেমিকা সোনালীকে বলে কি করছো তুমি। এসময় সোনালী তাকে বলে, অনেক পাপ করেছিস কলেমা পড়ে তওবা কর। ঘুমের ওষুধে নিস্তেজ শিপনকে এভাবেই তিনবার তওবা ও কলেমা পাঠ করার কথা বলে সোনালী।
অবশেষে গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। এরপর শিপনের বুকের ডান পাশ চিরে কলিজা বের করে দু’ভাগ করে খাটের ওপরে রেখে ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে যায় সোনালী। সেই ল্যাপটপ ও মোবাইল বিক্রি করার জন্য অনিকের কাছে রেখে আসে। অনিক সেই ল্যাপটপ বিক্রয় ডটকমের মাধ্যমে জনৈক জাহিদুলের কাছে ২২ হাজার টাকায় বিক্রি করে। আর সেই টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা অনিক নিজে রেখে ২ হাজার টাকা সোনালীকে দেয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. শওকত হাসান একই বছরের ৩০ এপ্রিল সোনালী ও অনিককে অভিযুক্ত করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) দাখিল করেন। মামলার চার্জশিটভুক্ত ২৩ সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন অতিরিক্ত এপিপি বীরেন্দ্র নাথ সাহা।
মন্তব্যসমূহ