- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
যদি আমার বোলারদের নিয়ে তাদের উদ্বেগ থাকে, তবে তাদের (আইসিসি) কর্মকাণ্ড নিয়েও আমার যথেষ্ট উদ্বেগ আছে।" -চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে
কথাগুলো বাংলাদেশ দলের কোচ হাথুরুসিংহের। কথাটি তিনি এমন এক প্রেক্ষাপটে বললেন, যখন টাইগার দলের মূল একাদশের দু'জন বোলারের দিকে অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের সন্দেহ ছুঁড়ে দিয়েছে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (আইসিসি)। একেবারে হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত যেন। যারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জায়গা করে নিয়েছেন অনেক আগেই, ঠিক বিশ্বকাপ মঞ্চে তাদের অ্যাকশন নিয়েই প্রশ্ন!
যদি হাথুরুর কথাটি সাদামাটাভাবে দেখা হয়, তবে মনে হবে বিষয়টি নিয়ে এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানোর কি আছে! আবার ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থাটির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালে টাইগার কোচের উদ্বেগের কারণটি খোলাসা হয়ে যায়। শর্ষের মধ্যে যখন ভূত থাকে তখন প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন তো উঠবেই।
ঘটনাটি নেড়েচেড়ে দেখতে চলুন একবছর পেছনে চোখ রাখি। দৃশ্যপট-২০১৫ সালের মার্চ। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বসেছে রঙিন পোশাকের বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচের বিশ্বকাপ। সেখানে দেখা মিলেছে অন্যরকম এক বাংলাদেশের। যাতে মাঠের পারফরমেন্স দিয়ে একের পর এক দাপুটে জয় তুলে নিয়ে বিশ্ব আসরের কোয়ার্টারে টাইগাররা। যেখানে প্রতিপক্ষ তিন মোড়লের অন্যতম ভারত।
যথারীতি মাঠের লড়াইয়ে দাপট দেখাতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। তখনই ঘটে যায় আইসিসির ম্যাচ অফিশিয়ালদের নগ্ন এক প্রদর্শনী। প্রথমে ব্যাটিংয়ে থাকা রোহিত শর্মার কোমরের নিচের ফুলটসকে 'নো' ডেকে বাঁচিয়ে দেন মাঠ আম্পায়ার। পরে টাইগারদের বিশ্বকাপ তারকা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ক্যাচ ভারতের শিখর ধাওয়ান তালুবন্দি করার সময় বাউন্ডারি লাইন স্পর্শ করলেও সেটিকে আউট দেন আম্পায়াররা।
সেই ঘটনায় ধিক্কারের রব উঠেছিল বিশ্ব-ক্রিকেট মহলে। পাকিস্তানি শোয়েব আখতার থেকে ক্যারিবীয় বরপুত্র ব্রায়ান লারা পর্যন্ত ম্যাচে নগ্ন হস্তক্ষেপের সমালোচনা করেছিলেন। সেসময়কার আইসিসি সভাপতি মোস্তফা কামাল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়েই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
সেই ম্যাচে মাঠের দুই আম্পায়ার ইয়ান গৌল্ড ও আলিম দারের আইসিসি তথা ভারতের হয়ে ম্যাচে বাজে সিদ্ধান্ত দেওয়ার নগ্ন পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচনার ঝড় থামতে সময় লেগেছিল ক্রিকেট বিশ্বের। আর এমন পরিস্থিতির জন্য তখনকার চেয়ারম্যান এন শ্রীনিবাসনের নির্দেশে ভারতের হয়ে আইসিসির কলকাঠি নাড়ার অভিযোগ ওঠে। যার জেরে মেলবোর্নের গ্যালারিতেই প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড তুলেছিলেন এক দর্শক, যাতে লেখা ছিল- 'ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল।!'
এরপর মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়িয়েছে, জল অনেকটা গড়িয়ে গঙ্গা-যমুনায় নতুন পলি পড়েছে। তবে সেদিনের সেই ঘটনার আগুন অবশ্য নিভিয়ে দিতে পারেনি গড়ানো সেই জল। বিশ্বকাপের যাত্রা কোয়ার্টারে থেমে গেলেও পরে টাইগারদের জয়রথ ছুটেছে। লাল-সবুজের মাটিতে বিধ্বস্ত হয়েছে অনেক পরাশক্তি। যার মাঝে ২-১ এ ওয়ানডে সিরিজ হেরে বাড়ি ফিরেছিল ধোনির ভারতও। তাতে আগুনের আঁচ খানিকটা কমেছিল হয়তো, কিন্তু আবারো সেটি মাথা চাড়া দিয়েছে আইসিসির অনাহূত এক সিদ্ধান্তে।
বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব খেলতে বাংলাদেশ দল এখন ভারতে। প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডসকে ৮ রানে হারিয়ে শুরু করার পরই মিলেছে অনাহূত সেই দুঃসংবাদটি। ম্যাচের দায়িত্বে থাকা দুই আম্পায়ার ভারতীয় সুন্দারাম রবি ও অস্ট্রেলীয় রড টাকার জয়ী দলের ড্রেসিংরুমে এসে জানিয়ে যান- টাইগার পেসার তাসকিন আহমেদ ও স্পিনার আরাফাত সানির বোলিং অ্যাকশনে সমস্যা দেখেছেন তারা।
এরপরই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, তাসকিন-সানি কি নেদারল্যান্ডসের ম্যাচেই প্রথম খেলতে নামলেন? আর দুই টাইগারের বোলিং প্রশ্নবিদ্ধ বলার জন্য এই ম্যাচের জন্যই কেন অপেক্ষায় থাকতে হলো আইসিসিকে? আইসিসিতে যে তিন মোড়লগিরি চলছে সেদিকে একটু ভালো করে তাকালেই এর উত্তর মিলবে। আর এখানেই কোচ হাথুরুসিংহের প্রতিক্রিয়াটি প্রাসঙ্গিকতা পায়।
হাথুরু যথার্থই বলেছেন- আইসিসির কর্মকাণ্ড নিয়ে তার যথেষ্ট উদ্বেগ আছে। কারণ কেবল তাসকিন বা সানি নন। একটু পেছনে তাকালে দেখা যায় অতীতে বড় টুর্নামেন্টে খেলতে এসে আইসিসির আতশকাঁচের নিচে পড়ার খড়গ নেমে এসেছিল অনেক নামীদামী বোলারেরই। যারা দীর্ঘ সময় মাঠ মাতিয়েছেন।
বিশ্বকাপের আগে আইসিসির সন্দেহের তালিকায় পড়ে কালোছায়া নেমে এসেছিল ক্যারিবীয় সুনিল নারিন, পাকিস্তানি সাঈদ আজমলদের। যাদের ক্যারিয়ারটাই এখন শঙ্কার মুখে। এমন ঘটনায় পড়তে হয়েছিল একই ম্যাচে সেঞ্চুরি ও দশ উইকেটের ইতিহাস গড়া তারকা টাইগার সোহাগ গাজীর ক্ষেত্রেও। বাদ যাননি ফর্মের তুঙ্গে থাকা আল-আমিন হোসেনও। অথচ পরে আল-আমিন আইসিসির সন্দেহকে অমূলক প্রমাণ করে বোলিং অ্যাকশন সঠিক বলেই পরীক্ষায় পাশ করে এসেছিলেন। টাইগার পেসারের সেই ঘটনা এবার ধেয়ে এসেছে তাসকিন-সানির দিকে।
এখন বলা যেতেই পারে- আইসিসির যখন একটি বোলিং নীতি আছে, সেটিতে তারা কারো অ্যাকশন অবৈধ হলে প্রশ্ন তুলতেই পারে। অভিযুক্তের উচিত পরীক্ষা দিয়েই সেটি ভুল প্রমাণ করা। এমন করে ভাবতে আসলে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু উদ্বেগটা তখনই বড় হয়ে দেখা দেয় যখন কোন একটি বৈশ্বয়িক টুর্নামেন্ট কাছাকাছি চলে এলে বা মাঠে গড়ালে কোন দলের মূল বোলারদের দিকে সন্দেহের তীর তাক করা হয়। কারণ অভিযুক্ত বোলাররা তো টুর্নামেন্টের ঐ ম্যাচেই প্রথম খেলতে নামছেন না। তারা দীর্ঘ সময় ধরেই মাঠ মাতিয়ে চলছেন।
তবে কেন এই সময়গুলো বেছে নেয় আইসিসি? আর এখানেই চলে আসে ক্রিকেটীয় রাজনীতি ও তিন মোড়লগিরির কলকব্জা নাড়ার বিষয়টি। যেটিকে সাদা চোখে দেখলেও একটি ষড়যন্ত্রের পার্শ্বরেখা চোখে পড়ে!
গত একবছর ধরেই বাংলাদেশ দলের আক্রমণভাগের মূল দায়িত্বটা সামলেছেন মুস্তাফিজুর রহমান ও রুবেল হোসেন। রুবেল চোটে বিশ্বকাপের দলে নেই। মুস্তাফিজ থেকেও না থাকার মত। বাছাইপর্বে তো নামতে পারবেনই না, মূলপর্বেও পুরো ফিট কাটার মাস্টারকে পাওয়া নিয়ে সন্দেহ আছে। এখন বাকি থাকল মাশরাফি বিন মুর্তজা, তাসকিন আহমেদ ও আল-আমিন হোসেন। আল-আমিন যেহেতু অল্পসময় আগেই আইসিসির পরীক্ষাগার থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে ফিরেছেন, তাকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ কম বা উল্টো প্রশ্নের মুখে পড়ার শামিল।
মাশরাফি দলের প্রাণভোমড়া হলেও দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত। এতদিন যখন তাকে নিয়ে প্রশ্ন ছিল না, আপাতত নতুন করে না থাকাটাই স্বাভাবিক। বাকি থাকল প্রতিপক্ষের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা তাসকিন। যার বল এশিয়া কপ থেকেই দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের কাছে। এশিয়া কাপে শুধু এই এক টাইগার বোলারকেই ভয় পেয়েছে ব্যাটসম্যানরা। সেই সঙ্গে দলে স্পেশালিষ্ট স্পিনার একজনই- আরাফাত সানি। ডাচদের বিপক্ষে দুই ওভার বল করেই সানি বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রতিপক্ষকে ঝামেলায় ফেলতে প্রস্তুত তিনি। সুতরাং হামলে পড়ো তাসকিন আর সানির ওপর!
বাংলাদেশ দলকে মানসিকভাবে ধাক্কা দেওয়ার জন্যই মূলত অতীতের মত আইসিসির আরেকটি মোড়লগিরি পরিকল্পনা এটি, এমন প্রশ্নই এখন ডানা মেলেছে। প্রশ্নটা কেন অবান্তর নয় সেটি আরেকটি তথ্যের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ডাচদের বিপক্ষে দায়িত্ব পালন করা দুই আম্পায়ারের একজন রড টাকার এই প্রথম বাংলাদেশের ম্যাচে দায়িত্ব পালন করলেন না, বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের ২-১ এ হেরে যাওয়া গত সিরিজেও মাঠ আম্পায়ারের দায়িত্ব ছিলেন তিনি। তাহলে টাইগার বোলারদের সন্দেহের চোখে দেখার জন্য বিশ্বকাপ মাঠে গড়ানো পর্যন্ত কেন অপেক্ষা করতে হলো টাকারকে? তাছাড়া আইসিসি এই অভিযোগগুলো এমন সময় সামনে আনে যাতে অভিযুক্তরা চেন্নাইয়ের অ্যাকশন পরীক্ষাগার ছাড়া অন্য কোথাও পরীক্ষা দিতে না পারেন! এবারো তার ব্যতিক্রম ঘটলো কি?
এমন আরো অনেক প্রশ্ন এখন সকলের মনেই। ঠিক যেমনটা বলেছেন টাইগার কোচ হাথুরুসিংহেও। কারণ 'রাইজ অব দ্য টাইগার্স' অনেকের ঘুম হারাম করে নিচ্ছে, সেটি এখন খোলাসাই। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আইসিসিকে ব্যবহার করে যেটা নিয়ে নগ্ন খেলায় মেতে উঠেছে কিছু-পক্ষ। হাথুরুসিংহেকে ধন্যবাদ, তিনি বিশ্বমঞ্চের আসরে কলকব্জা নাড়া একপক্ষের মাটিতে বসেই এমন দীপ্ত সত্যকথন করেছেন বলে। কেননা আইসিসির কর্মকাণ্ড নিয়ে গলা চড়াবার সময়টা এখন সময়ের দাবি!
বিশ্ব ক্রিকেটে 'তিন মোড়ল'- এর জমিদারি নাকি শেষ; এমনটাই জানিয়েছিল আইসিসি। কিন্তু বিসিবি বস নাজমুল হাসান পাপন স্পষ্ট জানিয়ে রেখেছিলেন- 'বিগ থ্রি, ছিল, আছে এবং থাকবে।' তার কথাটিই যেন সত্য হয়ে ধরা দিচ্ছি আবারো। যতো দোষ শুধু বিগ থ্রির বাইরে থাকা দেশগুলোর। ভারত, ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের অ্যাকশন প্রশ্নবিদ্ধ করার নজির কোথায়? জাসপ্রিত ভুমরার অ্যাকশন নিয়ে ফিসফাস হলেও তিনি ভারতীয় বলেই কি রিপোর্ট করতে 'ভয়' পাচ্ছেন আম্পায়াররা?
আইসিসির 'চক্রান্ত' দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। শ্রীনিবাসনরা যতোই নির্বাসনে যান, মোড়লদের জমিদারি আচরণ থেকে বুঝি বিশ্ব ক্রিকেট আর মুক্ত হচ্ছেই না!পরিবর্তন
মন্তব্যসমূহ