জিয়া ও মঞ্জুর হত্যার দায় অস্বীকার

politics (14)

বিএনপির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দাবি করেছেন, জিয়াউর রহমান হত্যায় তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর হত্যায়ও তার হাত ছিল না। জোর করে তিনি ক্ষমতা দখল করেননি। সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘আমার কর্ম আমার জীবন’-এ এরশাদ এসব দাবি করেছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একাধিকবার অভিযোগ করেছেন, জিয়া হত্যায় সম্পৃক্ততা ছিল তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদের। এরশাদ তার আত্মজীবনীর বিভিন্ন অংশে এ অভিযোগের জবাবে বলেছেন, জিয়া হত্যার প্রায় ৩৪ বছর পর এ অভিযোগ করতে শুরু করে বিএনপি। আগে কেন অভিযোগ করেনি। দলটি দুই মেয়াদে ১০ বছর ক্ষমতায় ছিল, তখনও অভিযোগ করেনি। ২১ বছর ধরে চলমান মঞ্জুর হত্যা মামলার মাধ্যমে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে বলে দাবি করেন এরশাদ।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তার শাসনকাল সম্পর্কে এরশাদ প্রশংসা করলেও, জিয়ার শাসনামলে সংঘটিত একাধিক সামরিক অভ্যুত্থানচেষ্টা এবং তা দমন ও সেনা কর্মকর্তাদের মৃত্যুদণ্ড নিয়েও কোনো কথা নেই তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদের আত্মজীবনীতে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সেনাসদস্যদের হাতে নিহত হন জিয়াউর রহমান। এ হত্যাকাণ্ডের দায় অস্বীকার করে এরশাদ লিখেছেন, ‘৩০ মে ভোর চারটার দিকে এই দুঃসংবাদ (জিয়ার মৃত্যু) জানতে পারি। …উপ-রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার তখন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আমি তৎক্ষণাৎ তাকে প্রেসিডেন্টের মৃত্যু সংবাদ জানাই এবং বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করি। জাতির ওই সঙ্কটকালে তার যে কোনো পদক্ষেপের প্রতি সেনাবাহিনীর পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেই’ (আমার কর্ম আমার জীবন’- পৃষ্ঠা ৬২)।
জিয়া হত্যার পরপরই সেনাসদর থেকে প্রচার করা হয় মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর বীরউত্তম এ ঘটনার জন্য দায়ী। তার নেতৃত্বে একদল বিপথগামী সেনাসদস্য রাষ্ট্রপতি জিয়াকে হত্যা করেছে। আত্মজীবনীতেও এরশাদ একই দাবি করেছেন। তার দাবি, মঞ্জুর ছিলেন ‘বিদ্রোহের নায়ক ও মূল পরিকল্পনাকারী’।
তবে সাংবাদিক লরেন্স লিফশুল্ৎজ ২৫ বছর আগেই লিখেছেন, ‘এরশাদের নির্দেশে ঢাকা রেডিও থেকে মঞ্জুরের বিরুদ্ধে এই মর্মে অবিরাম প্রচারণা চালানো হয় যে তিনি খুনি ও বিশ্বাসঘাতক।… তিনি (মঞ্জুর) মনে করেছিলেন, ঢাকা গ্যারিসনে অবস্থানরত তার শত্রুরা, বিশেষত এরশাদ ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল মহাব্বত জান চৌধুরী জিয়াউর রহমানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তাকে খতম করে দেবে।’ (কনফিউশন ওভার এ কিলিং- ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ, ১০ জুলাই ১৯৮১)।
লরেন্স লিফশুল্ৎজের তথ্যানুযায়ী, আবুল মঞ্জুর আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এরশাদের অনুসারীরা আলোচনার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে মঞ্জুরকে হত্যা করে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত মেজর জেনারেল মঞ্জুরের মেয়ে রুবানা মঞ্জুর একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাতকারেও একই দাবি করেছেন। লরেন্স লিফশুল্ৎজ তার লেখায় ইঙ্গিত করেছেন, এরশাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতেই জিয়াকে হত্যা করা হয়। আবুল মঞ্জুরকে জিয়ার হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে তাকেও হত্যা করা হয়। (কনফিউশন ওভার এ কিলিং- ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ, ১০ জুলাই ১৯৮১)।
জিয়া হত্যা প্রসঙ্গে এরশাদ লিখেছেন, ‘২৯ মে শুক্রবার জুমার নামাজের পর মেজর জেনারেল মঞ্জুর, লে. কর্ণেল মাহবুবুর রহমান ও মেজর খালেদ জেনারেল অফিসার কমান্ডিং অফিসে এক বৈঠকে মিলত হন। ওই বৈঠকে বিদ্রোহ সংগঠন ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার ভয়াবহ সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়।’ (আমার কর্ম আমার জীবন’- পৃষ্ঠা ৭৭)।
মঞ্জুর হত্যা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, পুলিশের হাতে গ্রেফতার মঞ্জুরকে ক্যাপ্টেন এমদাদ সেনানিবাসে নিয়ে আসেন। ‘হাটহাজারি থানা থেকে মেজর মঞ্জুরকে বহনকারী গাড়িটি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের অফিসার্স মেসের গেট দিয়ে প্রবেশ করে। ক্যান্টিন স্টোরের দোকানের সামনে জিপটি পেঁৗছার সাথে সাথেই ২০ থেকে ৩০ জনের মতো সশস্ত্র সৈনিক দল যানটি থামায়। …খুনিকে পেয়েছি বলে চিৎকার শুরু করে। …অফিসাররা যান থেকে নেমে এলেন এবং দেখতে পেলেন জেনারেল (মঞ্জুর) ড্রেনে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন।’ (আমার কর্ম আমার জীবন’- পৃষ্ঠা ৭৬)।
মঞ্জুর কেন জিয়াকে হত্যা করেছেন? সরকারি শ্বেতপত্রের বরাতে এর জবাবে এরশাদ বলেন, ‘দেশের শাসনভার অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে থাকতে হইবে, এমন বাতিকে তাহাকে পাইয়া বসে। প্রেসিডেন্ট জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তেমন কিছু করিতেছেন না বলিয়া তিনি ধারণা পোষণ করতেন।’ (আমার কর্ম আমার জীবন- পৃষ্ঠা ৭৫)।
জিয়ার সমালোচনাও করেছেন এরশাদ। তিনি লিখেছেন, ‘জেনারেল জিয়াকে দেখেছি, তার শাসনামলে দেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কারণ একনায়কত্ব ধরনের একটা ক্ষমতা তার ছিল। সংসদ থাকলেও তার হাতে এমন ক্ষমতা ছিল যা এর আগের রাষ্ট্রপতির ছিল না। সে কারণেই বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে দেশের অগ্রগতি হয়েছিল। …এটাও ঠিক তখন সত্যিকারের গণতন্ত্র ছিল না’ (আমার কর্ম আমার জীবন- পৃষ্ঠা ১৬৫)।
ক্ষমতা দখলের কারণ হিসেবে এরশাদ লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর দেশ এক ভয়াবহ অবস্থার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল। …ক্ষমতাসীন বিএনপি নভেম্বরের নির্বাচনে জয়লাভ করতে সমর্থ হলো কেবল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তিকে পুঁজি করে।’ (আমার কর্ম আমার জীবন- পৃষ্ঠা ৮৫)।
আবদুস সাত্তারের সময় ক্ষমতাসীন বিএনপি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে বলে দাবি করেন এরশাদ। শাহ আজিজুর রহমান ও মির্জা গোলাম হাফিজ উপরাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় নামেন। দলীয় মন্ত্রী-নেতা-কর্মীরা প্রেসিডেন্টের নাম ভাঙিয়ে সর্বত্র দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। (আমার কর্ম আমার জীবন- পৃষ্ঠা ৮৬)। এরশাদের মতে, দেশ পরিচালনায় অপারগ হয়ে আবদুস সাত্তার সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা ‘তুলে’ দেন।
জিয়া হত্যার পরপরই এরশাদ ক্ষমতা না নিয়ে ১০ মাস কেন অপেক্ষা করেছিলেন? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না থাকলেও, লরেন্স লিফশুল্ৎজের একাধিক লেখায় ইঙ্গিত করা হয়েছে, ক্ষমতা গ্রহণের পরিস্থিতি সৃষ্টির অপেক্ষায় ছিলেন এরশাদ। তবে এরশাদ আত্মজীবনীতে দাবি করেছেন, ক্ষমতা নেওয়ার ইচ্ছা থাকলে জিয়া হত্যার পরপরই নিতে পারতেন।
জিয়া হত্যার পরপরই এরশাদের রাজনৈতিক অভিলাষ প্রকাশ পেতে শুরু করে। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে সেনাপ্রধান এরশাদ সংবাদপত্রের সম্পাদকদের ডেকে ‘আমাদের সমাজে সেনাবাহিনীর ভূমিকা’ শীর্ষক বক্তব্য রাখেন। এ ঘটনার মাত্র তিন মাস পর আবদুস সাত্তারের পদত্যাগে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ ক্ষমতায় ‘আসেন’।
এরশাদের ক্ষমতা দখলের পরপরই মূলধারা ভেঙে ব্র্যাকেটবন্দি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্ম হয়। দলগুলো ছিল এরশাদের সমর্থক। ফলে সুসংহত হয় এরশাদের ক্ষমতা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেন ভাঙল? কারা ভাঙল? তার জবাব নেই এরশাদের আত্মজীবনীতে।

মন্তব্যসমূহ