সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান
এরপরও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারলাম না
মানুষ ভাবে এক, হয় অন্য। আমার বেলায়ও তাই। নিজের মধ্যে বরাবরই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল রাজনীতিতে থাকবো। নাকি আসলেই পুরোদস্তুর সাংবাদিক হবো। মুক্তিযুদ্ধ না হলে হয়তো আমার স্বপ্নের আঁতুড়ঘরেই মৃত্যু হতো। বলে রাখি বেঁচে আছি এ যেন এক বিস্ময়কর ঘটনা। পাকবাহিনীর হাতে রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করা অবস্থায় কজন বেঁচে আছে। ব্রাশফায়ারে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। আমারও হতে পারতো। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ। ভোর সাড়ে পাঁচটা। মৌলভীবাজার সরকারি হাইস্কুলের সামনে সদর রাস্তায় ৭ বন্ধু মিলে ব্যারিকেড তৈরি করলাম। কি পাগলামি দেখুন। খালি হাতে পাকবাহিনীর গতিরোধ করবো? দুদিন আগেই ঢাকা থেকে ফিরেছি। মনের মধ্যে প্রতিরোধের আগুন জ্বলছে। কোন কিছু টের পাবার আগেই পেছন থেকে একটি ট্রাক এলো। হল্ট বলতেই আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। আমাদেরকে গাড়িতে তুলল পাকবাহিনী। পাশে ছিল মুজিবুর রহমান মুজিবের বাসা। সেখানেও পাকবাহিনী অভিযান চালালো। তখন তিনি বাসায় নেই। আগেই টের পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পেয়ে গেল আরেক ছাত্রনেতা গাজী গোলাম ছরওয়ারকে। সাধারণ বেশে থাকতেন গাজী ভাই। নিজেকে ‘নওকর’ বলে পরিচয় দিলেন। স্থানীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা হাসেম মোল্লা সমর্থন দিলেন। পাকবাহিনী বিশ্বাস করে তাকে ছেড়ে দিল। হাসেম মোল্লা মুক্তিযুদ্ধের নির্ভেজাল সমর্থক ছিলেন। আমাদেরকে নিয়ে ট্রাক চলছে। উর্দুতে পাকবাহিনী নিজেদের মধ্যে কি যেন কথাবার্তা বলছে। তবে প্রচ- রাগ মনে হচ্ছে। চোখ বেঁধে রেখেছে আগেই। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। পাহাড়ের উঁচুনিচু পথে এক জায়গায় থামলো। এরপর হাত বেঁধে ফেললো। অন্ধকার একটি প্রকোষ্ঠে নিয়ে গেল। প্রথমে শুরু হলো মানসিক নির্যাতন। দেয়ালের সঙ্গে ঠেকিয়ে একজন ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করলো কি করা হয়। পাশে হাসেম মোল্লা। বললাম সাধারণ ছাত্র। রাজনীতি করি না। লেখালেখি করি তাও বললাম না। প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইল না। হাসেম মোল্লা বললেন, মতিউর কিছুতেই নেই। বন্ধুদের সঙ্গে রাস্তায় এসেছিল। কি মনে করে ওরা বিশ্বাস করলো। তবে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। দুই হাত বেঁধে পেছনে রাইফেলের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করছে। এখনও অমাবস্যার রাতে প্রচ- ব্যথা হয়। আর হাতের আঙ্গুলতো অপারেশন করতে হয়েছিল। কে কোথায় আছে জানি না। শুধু চিৎকার শুনছি। সাত বন্ধুর মধ্যে কানু সেন ছিল অন্যতম। পাশের রুমে তার চিৎকার শুনছিলাম। গভীর রাতে সেটাও থেমে গেল। ওইদিনই কানুসহ আরও চারজনকে নিয়ে গিয়ে জল্লাদ বাহিনী মনু নদীর সেতুর ওপর ব্রাশফায়ার করে। কি বীভৎসতা। মুক্ত হয়ে পরে শুনেছি কানুকে ওরা কিভাবে মেরে উল্লাস করছিল। বন্দিদশা চললো তিনদিন, তিনরাত। সারা দিনে একখান রুটি। জানি না ভাগ্যে কি আছে। এক কাপড়ে তিনদিন কাটানো। এরমধ্যে হাত বাঁধা। নির্যাতন আর জিজ্ঞাসাবাদ তখনও অব্যাহত। ক্রসফায়ার করার কথা তখন শুনেছিলাম। এখন দেখতে পাই। রুমে ঢুকেই এক একজন বলতো ক্রসফায়ার করে দিচ্ছে না কেন? রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়ার শাস্তিতো এটাই। নিশ্চিতভাবে ধরে নিচ্ছি যে কোন সময় ক্রসফায়ারে নেয়া হচ্ছে। প্রতিবাদের ভাষা তখন জানা ছিল না। তবে প্রতিরোধের আগুন তখন জ্বলছে বুকের ভেতর। ঘেন্না ধরেছে এই নরপশুদের ওপর। মানবসভ্যতার সূচনাতেই মানুষ লড়াই করছে ন্যূনতম চাহিদার জন্য। কখনও খাদ্যের জন্য। কখনও শান্তির জন্য। আর আমরা লড়ছি স্বাধীনতার জন্য। যদিও বিস্তারিত কিছুই জানি না। শুধু বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনেছি। যে ভাষণে এক ধরনের কৌশলী নির্দেশনা ছিল। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় কি হয়েছে জানি না। পাকবাহিনী নিরীহ বাঙালির ওপর কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাও শুনতে পাইনি। কারণ ভোরবেলায় পাকবাহিনীর সরাসরি অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছি। এক সুযোগে গোয়েন্দা হাসেম মোল্লা এসে বললেন কোন অবস্থাতেই যেন ছাত্রলীগ করি না বলি। বাঙালি এই কর্মকর্তার কাছে ঋণের শেষ নেই। তার কথামতো টর্চার সেলে তাই বললাম। তাতে কি! ওরা কি বিশ্বাস করে। ৭২ ঘণ্টা পর হাত মুক্ত হলো। রশি খুলে নিল দুই জওয়ান। রাত হয়েছে এটা বুঝতে পেরেছি। এমন সময় এলেন এক বাঙালি ক্যাপ্টেন। নিয়ে গেলেন অন্য এক রুমে। বললেন, তোমাকে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিশ্বাস হচ্ছে না। মনের মধ্যে ভয়। পেছন থেকে যদি গুলি করে দেয়। বললাম নামাজ পড়ার সুযোগ পাবো কিনা? রাইফেল হাতে এক জওয়ান পাশের রুমে নিয়ে গেল। চার রাকাত নফল নামাজ পড়লাম। দোয়া-দরূদ পড়ছি। বাবা, ভাই-বোনের কথা মনে হলো। ক্যাপ্টেন আবার ঢুকলেন। চলো তোমাদেরকে দিয়ে আসি। গভীর জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেলেন এই বাঙালি সেনা অফিসার। শব্দ করে বললেন তোমরা মুক্ত। তবে তিনজন একসঙ্গে যাওয়া চলবে না। এরপর কিভাবে ওখান থেকে বের হলাম এখনও মনে করতে পারি না। মনে মনে ভাবি এটাও কি সম্ভব। অনেকটা অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলাম। যেমন প্লেন দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়ার মতো। কোথায় যাবো, কিভাবে যাবো জানি না। শহরে কার্ফ্যু তখনও জারি রয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে চলেছি। টাকা-পয়সা কিছুই নেই। না খাওয়া অবস্থায় তিনদিন। দিনে একখান আর রাতে একখান রুটি কিভাবে চলে। হাঁটা ছাড়া বিকল্পও নেই। হাঁটতে হাঁটতে পরদিন যখন বাড়ি পৌঁছালাম তখন বিকেল হয়ে গেছে। গ্রামের প্রবেশ পথে ঢুকতেই মছন্দর আলী বলরেন, ও মাগো আপনি বেঁচে আছেন! জড়িয়ে ধরে বললেন, বাড়িতে তো কুলখানি হয়ে গেছে। নিশ্চিত খবর এসেছে আপনাকে ওরা মেরে ফেলেছে। চোখে তখন জল। কিছুটা হতবিহ্বলও। বললাম, সবই আল্লাহর ইচ্ছে। পুরো গ্রামের মানুষ তখন আমাদের বাড়িতে। মায়ের কান্না থামলো বটে। কিন্তু পিঠের দাগ দেখে মায়ের কান্না কিভাবে থামে। আসলে বারবারই মনে পড়ে কি করে বেঁচে এলাম পাকবাহিনীর হাত থেকে। ওদের কাছ থেকে বেঁচে যাওয়া ছিল এক বিস্ময়কর ঘটনা। আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারি না বেঁচে আছি। দুঃখ কি, এরপরও আমি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারলাম না। হতে পারে সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য ধর্না দেইনি। বা সার্টিফিকেট নেইনি। কেন যে নিলাম না এখন মাঝে মধ্যেই ভাবি বড় ভুল করে ফেলেছি। মৌলভীবাজারের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অবশ্য আমার নাম ছাপা হয়েছে বহুবার। তাতে কি? আমার কোন আপসোস নেই।
মন্তব্যসমূহ