সিপন আহমেদ : আগামী মাসেই অনুষ্ঠিত হবে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র জাতীয় কাউন্সিল। কেমন নেতৃত্ব আসছে এই কাউন্সিলে? দুই দলের জাতীয় কাউন্সিল উৎসবকে সামনে রেখে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মুখে মুখে এই একই প্রশ্ন। আগের কাউন্সিলকে ঘিরে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে নানা চমক এলেও এবার কোন দলেই বড় কোন চমক আসছে না বলেই জানা গেছে। বড় পদগুলোতে বর্তমান নেতৃত্বকে বহাল রেখেই নিয়মরক্ষার জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানে জোর প্রস্তুতি আর প্রত্যাশিত পদ পেতে নেতাদের দৌড়ঝাঁপে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে ইতিমধ্যে।
দুই দলের প্রথম সারির নেতাদেও সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার দলে কিছুটা পরিবর্তন আসলেও উভয় দলেরই সভাপতি ও সম্পাদক পদ বহাল থাকবে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বহাল রাখার পাশাপাশি এবারও আওয়ামী লীদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে থাকবেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে ভারমুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করা হবে। আগামী ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে উপমহাদেশের প্রাচীন দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন। অন্যদিকে রাজপথের বিরোধী দল বলে খ্যাত বিএনপি আগামী ১৯ মার্চ কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের চিন্তাভাবনা করছে। বড় এসব রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে পদপ্রত্যাশী নতুন-পুরনো নেতাদের পদচারণায় এখন মুখর। তবে এসব দলের নীতিনির্ধারক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আভাস পাওয়া গেছে, কেন্দ্রীয় সম্মেলনে প্রধান প্রধান পদগুলোতে তেমন কোন পরিবর্তন আসছে না। তবে সাংগঠনিক কাঠামোয় দলগুলো কিছু পরিবর্তন এনে কেন্দ্রীয় কমিটির কলেবর বৃদ্ধি, মধ্য সারির পদগুলোতে কিছু রদবদল ছাড়া বড় কোন চমক আসছে না। আওয়ামী লীগে আসছে না বড় কোন চমক : আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন সফল করতে চলছে জোর প্রস্তুতি। জাতীয় সম্মেলনের আগেই বাকি থাকা মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা সম্মেলন সম্পন্ন এবং সম্মেলন হওয়া সকল জেলা-মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার জন্য এখন মহাব্যস্ত দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা। তবে দলটির জাতীয় সম্মেলনকে ঘিরে দলটির কোটি কর্মী-সমর্থকদের মুখে মুখে একই প্রশ্ন কে হচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রধান কর্মসচিব সাধারণ সম্পাদক? সৈয়দ আশরাফুল ইসলামই কী ওই পদে হ্যাটট্রিক করছেন? নাকি নতুন কেউ আসছেন ওই পদে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আভাস পাওয়া গেছে- এখন পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক পদে সৈয়দ আশরাফই এগিয়ে রয়েছেন জনপ্রিয়তার বিচারে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে একই নেতৃত্ব বহাল থাকার সম্ভাবনা থাকলেও দলটির সাংগঠনিক কাঠামোয় বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হবে জাতীয় কাউন্সিলে। এ নিয়ে কাজও শুরু করেছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। দলের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র সংশোধন করতেও শুরু হয়েছে তৎপরতা। সভাপতিম-লীর সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় সদস্য পদের সংখ্যা সামান্য বৃদ্ধি, কয়েকটি নতুন সম্পাদক পদ সৃষ্টি, সাংগঠনিক ইউনিট বৃদ্ধি, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্টকরণসহ বেশকিছু পরিবর্তন আনা হবে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্মেলনে সভাপতি পদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনর্বার নির্বাচিত হবেন- এটি নিশ্চিত। কেননা ওই পদে অন্য কাউকেই মেনে নেবে না দলটির কোটি নেতা-সমর্থকরা। আর এ পদে কোন প্রতিদ্বন্দ্বীও নেই। সাধারণ সম্পাদক পদে বেশ ক’জনের নাম আলোচনায় এলেও শেষ পর্যন্ত সৈয়দ আশরাফই তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনায় প্রবল। তবে আলোচনায় সৈয়দ আশরাফের পাশাপাশি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নাম রয়েছে। দলটির একাধিক সূত্র থেকে ধারণা পাওয়া গেছে, সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী বডি হিসেবে খ্যাত সভাপতিম-লীতেও খুব একটা পরিবর্তন আসছে না। ১৩ সদস্যের সভাপতিম-লীর সংখ্যা বাড়িয়ে ১৫ সদস্য করার চিন্তাভাবনা রয়েছে দলের হাইকমান্ডের। তবে সভাপতিম-লীতে বর্তমানে উপদেষ্টাম-লীতে থাকা দলটির কয়েকজন প্রবীণ নেতাকে ফিরিয়ে আনা হতে পারে। এছাড়া গত সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদপড়া আওয়ামী লীগের বেশ ক’জন সাবেক নেতাকে দেখা যেতে পারে আগামী কমিটিতে। তবে নানা কারণে বিতর্কিত এবং সাংগঠনিক কর্মকা- থেকে নিষ্ক্রিয় থাকা কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত নতুন কমিটি থেকে বাদ পড়তে পারেন বলেও আভাস পাওয়া গেছে। এছাড়া পদোন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার। তবে এবারের জাতীয় সম্মেলনে সাংগঠনিক জেলা কমিটির সংখ্যা ৭৩ থেকে বাড়িয়ে ৭৭ করা হচ্ছে। ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও কুমিল্লাকে বিভাগের মর্যাদা দিয়ে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের সংখ্যা ৭ থেকে বাড়িয়ে ১০-এ উন্নীত করা হচ্ছে। তথ্য ও প্রযুক্তি, মানবাধিকার, প্রশিক্ষণসহ কয়েকটি সম্পাদকম-লীর নতুন পদ সৃষ্টি করা হবে। এছাড়া বর্তমানে ৭৩ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সংখ্যা বাড়িয়ে ৮১ করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। দলীয় গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র সংশোধনীর কাজে থাকা কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলের গঠনতন্ত্রে সংশোধনী, নতুন পদ সৃষ্টি ও কার্যনির্বাহী সংসদের কলেবর বৃদ্ধি নিয়ে নানা আলোচনা দলের মধ্যে রয়েছে। তবে কোনকিছুই এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এ নিয়ে দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তবে কাউন্সিলের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মেলন প্রস্তুতির আহ্বায়ক করে ১০টি উপ-কমিটি গঠনের কাজ শেষ পর্যায়ে। দ্রুতই তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য দলীয় সভানেত্রীর কাছে পেশ করা হবে। বিএনপিও সম্মেলন ঘিরে সরগরম : জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কার্যত কোণঠাসা বিএনপি কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে। দীর্ঘদিন পর দলের জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি পর্বে নিষ্ক্রিয়-সক্রিয় নেতাদের পদচারণায় প্রতিদিনই মুখর থাকছে দলের পল্টন ও গুলশানের কার্যালয়। বর্তমান পদ ধরে রাখতে এবং পদোন্নতি পেতে দলটির বড় নেতারা এখন হঠাৎ করেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চেয়ারপারসন পদে খালেদা জিয়া নিশ্চিত হলেও বিএনপিতে এখন প্রধান আলোচনাই হচ্ছে পরবর্তী মহাসচিব কে হচ্ছেন? দলের বেশিরভাগ নেতারই ধারণা, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মাধ্যমে ভারমুক্ত হয়ে পূর্ণ মহাসচিব হচ্ছেন। মির্জা ফখরুল ছাড়াও দলটির স্থায়ী কমিটিতে মহাসচিব হওয়ার মতো বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা থাকলেও খালেদা জিয়ার কাছে তাঁরা পরিপূর্ণ আস্থা অর্জন করতে পারেননি। বরং দলটির চরম দুঃসময়ে পাশে না থেকে বেশিরভাগ নেতার পলায়নপর কৌশলে তাঁদের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ বিএনপি চেয়ারপারসন। ফলে আলোচনা যাই-ই হোক, মির্জা ফখরুলই যে পরবর্তী মহাসচিব হচ্ছেন এমনটিই ধারণা করা যায়। তবে দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে লন্ডনে থাকা তারেক রহমান পুনর্বার বহাল থাকছেন কি না, এ নিয়ে দলটিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিএনপির উদারপন্থী বলে খ্যাত অংশের নেতারা ওই পদে তারেক রহমানকে না রেখে অন্য কাউকে রাখার পক্ষে। কঠোরপন্থীরা তারেক রহমানকেই রাখতে চান ওই পদে। আর দলের প্রধান খালেদা জিয়াও নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত তারেক রহমানেরই পক্ষে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একাধিক নেতা জোর দিয়েই বলেছেন, শুধু সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানই নয়, সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপির আগামী কেন্দ্রীয় কমিটি তারেক রহমান যা বলবেন সেভাবেই গঠিত হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির আগামী নেতৃত্বেও বড় ধরনের কোন চমক থাকছে না। তবে গত সাত বছর ধরে চলা দলের চরম দুঃসময়ে বিতর্কিত কিছু নেতাকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে বাদ দিতে পারেন। অপরদিকে পদোন্নতি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তারেকপন্থী বলে খ্যাত মধ্যম সারির বেশ কয়েকজন নেতার। দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী বডি স্থায়ী কমিটিতেও বেশ কিছু রদবদল ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আগামী কাউন্সিলের মাধ্যমে একই নেতার একাধিক পদে থাকার বিধানটি সংশোধনী করা হতে পারে। তেমনি হলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা আর দলটির অন্যকোন সংগঠনের পদে থাকতে পারবেন না। |
মন্তব্যসমূহ