যুদ্ধশিশুদেরকে ‘বিজয় শিশু’ বলা উচিৎ: তুরিন আফরোজ

ঢাকা : একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মামলা পরিচালনা করে তাদেরকে উপযুক্ত বিচারের কাঁঠগড়ায় দাঁড় করাতে নিরলস পরিশ্রম করছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম। মামলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে তাদেরকে তদন্ত সংস্থার সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করতে হয়েছে। বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণ খুঁজতে গিয়ে তারাও হয়েছেন কালের নতুন সাক্ষী। ঘটনাবহুল নির্মম সেই একাত্তরকে নিয়ে বিশেষ এই প্রতিবেদনটিকে সাজানো হয়েছে। ধারাবাহিক এই প্রতিবেদনের আজকের অংশে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ তার দেখা সেই নির্মম অভিজ্ঞতার কথা বাংলামেইলের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।  
প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘পৃথিবীতে যতগুলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে তার অধিকাংশ বিচার অপরাধ সংঘটনের কাছাকাছি সময়ে হয়েছে। ফলে কোথাও কোনো যুদ্ধশিশুকে সাক্ষী হতে দেখিনি। বাংলাদেশে আমরা প্রায় চল্লিশ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরু করেছি। সেখানে একজন পূর্ণবয়স্ক যুদ্ধ শিশুকে পাওয়া এবং খুঁজে বের করা আমার জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল।’ 
‘ট্রাইব্যুনালে যোগ দেবার পর, ধর্ষণের ফলে যেন মৃত্যুদণ্ড হয় এমন একটি মামলা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলাম। এরপর কায়সারের মামলাটি হাতে আসলে সেখানে বীরাঙ্গনা মাজেদা এবং তার যুদ্ধশিশু সামছুন নাহারের খোঁজ পেয়ে যাই। প্রায় ১ বছর নানাভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি।’ 
‘মূলত ধর্ষণের যে কষ্ট, তা মৃত ব্যক্তির কষ্টের চেয়েও ভয়াবহ। ধর্ষিতাকে বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়। প্রতিটি মুহূর্তে তার মৃত্যু ঘটে। সমাজ তাকে কাছে টেনে নেয় না। তার পরিবার কাছে টেনে নেয় না। সে তখন সম্মান না পেয়ে বেঁচে থাকাকে খুব দুঃসহ বলে বোধ করে। তাই এই মামলা করার সময় যুদ্ধশিশুদের ইতিহাসকে সামনে তুলে আনাই ছিল আমার প্রধান উদ্দেশ্য।’
‘তথ্যানুযায়ী আমাদের দেশের অনেক যুদ্ধশিশুকেই একাত্তরের পর বিদেশে দত্তক হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবুও আমরা যুদ্ধশিশু খুঁজতে গিয়ে সামছুন নাহারের দেখা পাই, যিনি কিনা একজন নারী এবং তিনি এই বাংলাদেশেই বড় হয়েছেন। আমি তখন সামছুন নাহারের কণ্ঠকে পৃথিবীর বুকে হাজারো যুদ্ধশিশুর কণ্ঠ হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছি। যে কিনা বিচার চাইবে তার মায়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপরাধের জন্য, বিচার চাইবে তার নিজের জন্য।’ 
‘কায়সারের মামলা পরিচালনার সময় সামছুন নাহারের জীবনের কষ্ট, প্রতিবন্ধকতার নির্মমতা সম্পর্কে শুনতে থাকি। সব চেয়ে দুঃখের বিষয়, একজন যুদ্ধশিশুকে জন্মের পরই শুনতে হয় সে ‘জারজ’ সন্তান। তাই আমি যখন এ মামলাতে আইনি যুক্তি উপস্থাপন করি তখন ট্রাইব্যুনালকে বলি, একজন যুদ্ধশিশুর জন্মই যেন আজন্ম পাপ। এই পাপ মোচন কখনো হয় না। তাকে সারা জীবন এই পাপ বহন করতে হয়, লাঞ্ছিত হতে হয়। তার পরিবারসহ সে সমাজের কাছে হয়ে পড়ে অপাঙতেয়।
মামলার এই অভিযোগে মাজেদাকে ধর্ষণের অপরাধে আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। একজন নারী প্রসিকিউটর হিসেবে অন্য নারীর জন্য যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলাম সেটি সফল হয়েছে।’ 
‘আমি ভাবি, একাত্তরের পর ১৯৭২ সালের বৈশাখ মাসে সামছুন নাহার যুদ্ধশিশু হিসেবে জন্ম নেয়, আর আমিও একই সময়ে জন্ম নিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরে বেরাই, গর্ব করি। কিন্তু সামছুন নাহার তা পারে না। অথচ সামছুন নাহারেরও অধিকার আছে এই স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার, মায়ের আত্মত্যাগ নিয়ে গর্ব করার। কিন্তু সেটি আমরা হতে দেখিনি। সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে এ মামলায় আমরা যুদ্ধশিশুকে হাজির করে তার সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের কাছে নজির তৈরি করেছি। এর মাধ্যমে আমরা যুদ্ধশিশুদের নিয়ে আমাদের সামাজিক নীরবতা ভাঙতে চেষ্টা করেছি।’ 
মামলা চলাকালীন সময়ে ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধশিশুদের নিয়ে আমাদের নীরবতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলি, এই নীরবতার ব্যাখ্যা শুধু রাষ্ট্রই দিবে না। এর ব্যাখ্যা সমাজকেও দিতে হবে। আমরা কি তাদের আপন করে নিয়েছি? আমাদের মধ্যে কয়জন গর্ববোধ করি বলতে, আমার মা অথবা আমার বোন অথবা আমার সন্তান একজন বীরাঙ্গনা? এ কথাতো আমরা বলতে পারি না!’
‘আমাদের সমাজে বীরাঙ্গনা এবং যুদ্ধশিশু সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা রয়েছে তা অত্যন্ত জঘন্য। সেই ব্যাখ্যা অনুসারে আমরা মনে করি, যুদ্ধশিশু ও বীরাঙ্গনা বলতে জারজ সন্তান এবং ধর্ষিতা নারীকে বোঝায়। কিন্তু এর পরিবর্তন করতে হবে। এই যুদ্ধশিশুদেরকে ‘বিজয় শিশু’ বলা উচিৎ বলে মনে করি। কারণ, তারা সারা জীবনই নিজেদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। এ বিষয়ে আমরা সমাজের নীরবতা ভাঙতে চাই। তাই আমরাও ভবিষ্যতের আরো কিছু মামলায় কিছু যুদ্ধশিশুকে সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
‘একাত্তরের পর বীরঙ্গনা মাজেদা বাবার বাড়িতে যুদ্ধশিশু সামছুন নাহারের জন্ম দেন। এরপর সামছুন নাহারকে তার স্বামী আঁতাই মিয়া নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে তাদের আরো সন্তানের জন্ম হয়। এর মাঝে প্রায় ৫ বছর যুদ্ধশিশু সামছুন নাহারের সঙ্গে তার মা মাজেদার কোনো যোগাযোগ ছিল না। সে নানার বাড়িতে বড় হতে থাকে। আঁতাই মিয়া তার অন্য সন্তানদের মত যুদ্ধশিশু সামছুন নাহারের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করতেন। নানা বাড়িতে বড় হবার পর সামছুন নাহারকে বিয়ে দেয়া হয়। সামছুন নাহার বীরাঙ্গনার সন্তান জানতে পেরে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে মারধর করে বের করে দেয়। পরে তার স্বামী আরেকটি বিয়ে করে।’ 
‘সামছুন নাহার এখন একাই বসবাস করছে। এমনকি এই মামলায় সাক্ষ্য দেবার পর থেকে সে এখন আর এলাকায় থাকতে পারছে না। বিভিন্নভাবে তার ওপর ভীষণ হুমকি আসছে। সে বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্য এক শহরে থাকে। সে বলেছে, দরকার হলে সে দেশ ছেড়ে চলেই যাবে। আসলে তার কোনো ঘর নেই, কোনো দেশ নেই। আমাদের দুঃখ, আমরা এখনো যুদ্ধশিশুদেরকে আপন করে নিতে পারিনি।’   
চোখে দেখা আপন অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে গিয়ে ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ এ প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ আরো জানান, জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান, গোলাম আযম, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মো. আব্দুল আলীম, সৈয়দ মো. কায়সার, মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাশেম আলী, আব্দুস সোবহান, এটিএম আজহারুল ইসলামসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামালাতে আইনি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তিনি। এছাড়া বর্তমানে তিনি জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, পটুয়াখালী, দুর্গাপুরসহ বিভিন্ন স্থানের মোট ৮টি মামলা পরিচালনা করছেন।

মন্তব্যসমূহ