ভগবানকে মানুষের হাত থেকে বাঁচানো উচিত || তসলিমা নাসরিন

উড়ালপুল ভেঙে পড়েছে কলকাতায়। মানুষগুলো যেভাবে ইট-সিমেন্টের তলায়, গাড়ির তলায়, লোহা-লক্করের তলায় চাপা পড়ে মারা গেল, দেখলে গা শিউরে ওঠে। কত মানুষ কাতরাচ্ছে! একটুখানি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেই ওদের অনেককে বাঁচানো যায়। কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকার লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। দুর্ঘটনা নিয়েও নাকি রাজনীতি হচ্ছে। উদ্ধারকাজ নিয়েও। মানুষের মৃত্যু নিয়েই যখন রাজনীতি হয় এ তল্লাটে, তখন কোনও কিছু নিয়েই হওয়া রাজনীতি আমাকে আর অবাক করে না। আমাকে নিয়েও তো হয়েছিল রাজনীতি, আমার মতো নিরীহ লেখককে তাড়িয়ে দিলে নাকি তেনারা মানে ভদ্দরনোকেরা ভোট পাবেন। এখন ক্ষমতাময়ী রমণীও শুনেছি ভোট আবার কমে যায়, ভয়ে আমাকে বাংলার ত্রিসীমানায় দেখতে রাজি নন।
উড়ালপুলের কথা হচ্ছিল। উড়ালপুলও যে এভাবে কখনও ভেঙে পড়তে পারে, তা আমার ধারণার মধ্যেই ছিল না। পেপার মাশে দিয়ে পুলটি বানানো হচ্ছিল কিনা কে জানে! ইট সিমেন্ট ইস্পাত ঠিক ঠাক দেয় তো লোকে, নাকি? শুনেছি সরকার থেকে নাকি ঘনঘন চাপ দেওয়া হচ্ছিল পুলের কাজ শেষ করার জন্য, শেষ করলে উনি জনগণকে বলবেন, ‘দেখলে তো দু’কিলোমিটার দীর্ঘ কী বানিয়েছি আমি! ভোট যেন আমার পাতে ছাড়া অন্য কোনও পাতে না পড়ে’। তাড়াহুড়ো করার কারণেই কি হুড়মুড়োলো?
সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার করেছে কনস্ট্রাকশান কোম্পানি, যেটি কলকাতার উড়ালপুলটি বানাচ্ছে। বলে দিয়েছে, ‘এ ভগবানের কাজ।’ মানে উড়ালপুল ভেঙে পড়ার কাজটি ভগবান করেছে। তারা বলতে চাইছে, তারা নির্মাণের কাজটি করেছে, ভগবান করেছে ধ্বংসের কাজটি, মানে অপকর্মটি। বেচারা ভগবান! যত দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, যত ধ্স, ধ্বংস, যত মৃত্যু— সব কিছুর দায় নিতে হয় তাকে।
ভগবানকে মানুষের হাত থেকে বাঁচানো উচিত আমাদের। অপরাধীদের চিহ্নিত করা উচিত। ভগবান থাকলে সবচেয়ে বেশি লাভ অসৎ ব্যবসায়ী, ঠগ জোচ্চোর, বদমাশদের। ওরা নিজেদের অপকর্মগুলো ভগবানের ঘাড়ে বেশ চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা রেহাই পেতে চায়। ভগবান মাইন্ড করেন না। অবশ্য থাকলে তো মাইন্ড করবেন!

মন্তব্যসমূহ