আরিফ চৌধুরী শুভ
ভয়ংকর অভিজ্ঞতা! এই শহরে চলতে গিয়ে এত ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আর কখনো হইনি। এই অভিজ্ঞতা ছিল সমাজের উচ্চ মহল থেকে বঞ্চিত মানুষ আর অভিজাত হোটেলের রুচিপূর্ণ খাবার থেকে বঞ্চিত কুকুরের অভিশাপ।
বহুরুপি মানুষ আছে যারা নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে অন্যের উপর হায়েনার মত আক্রমণ করে। কিন্তু একটি চতুষ্পদী প্রাণী কিভাবে অশান্ত হয়ে উঠে অধিকার বঞ্চিত হলে সেটি সত্যি ভয়ংকর। গ্রিণরোডে কম্পোট হাসপাতালের উল্টোপাশে চার বছরের ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বৃদ্ধ নারীটি। সারদিন ক্ষুধার্ত শিশুটির হাতের বিস্কুটি মনের আনন্দে খাচ্ছে হাত ছেটে। পাশে বাহারি শীতের পিঠার পসরা সাজানো দোকানটি ঘিরে মুখরোচকদের জটলা।
ফখরুদ্দিন রেস্তোরার কর্মচারীর দৌড়ানি খেয়ে সারাদিন অভুক্ত কুকুরটি প্রতিশোধ প্রবণ হয়ে উঠল। কুকুরটির ব্যাবাক সিদ্ধান্তে হঠাৎ জড়ো হলো জনাপঞ্চাশেক মানুষ। তখনও নিজের চোখকে বিশ্বাসই করাতে পারছি না ততক্ষণে কি ঘটেছে। শিশুটি সামনে দাঁড়ানো কুকুরটির আশা ছিল বিস্কুটের ভাগ তাকেও দেওয়া হবে। ক্ষুধার রাজ্যে শিশুটি এমন তত্ত্ব সত্যি মানতে নারাজ। শুরু হলো দুটি অবলা প্রাণীর লড়াই।
গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে কুকুরটি কামড়িয়ে শিশুটিকে মায়ের কোল থেকে মাটিতে ফেলার সমস্ত চেষ্টিই ব্যর্থ হলো। অবশেষে নিজের পরাজয় নিশ্চিত জেনে কুকুরটি পটাপট কয়েকটা কামড় বসিয়ে দিল ভিক্ষুকের হাতে।
জটলা বাঁধা জনতাকে এই আনন্দ বেশি ক্ষণ উপভোগ করতে দেননি মোমেনা আক্তার লিপি নামের একজন মা। দৌড়ে গিয়ে নিজের হাতের বেগ দিয়ে আলাদা করেছেন ক্ষুধার্ত কুকুর আর অভুক্ত মানব শিশুকে।
ততক্ষণে ভিক্ষুকের হাতের টপটপ পড়া লাল রক্তে তৃষ্ণা মিটছে মাটিতে পাতানো ইটের। কিন্তু টাই পেন্ট পরা মানুষের দেখার তৃষ্ণা মিটছে না। আফসোস নেই উপস্থিত কারো। চোখে অশ্রু নেই আহত ভিক্ষুকের। অাতঙ্ক নেই চার বছরের ছেলেটির মধ্যেও।
কুকুরের সাথে যাদের বসবাস তাদের আবার কিসের কুকুর ভয়? উপস্থিত জৈনিক ভদ্রলোকের এমন প্রশ্নে ভিক্ষুকটি লজ্জা না পেলেও লজ্জা আর ভয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো আক্রমণকারী কুকুরটি। অবুঝ শিশুটি কুকুরকে তার খেলার সাথী মনে করলেও মায়ের রক্তের পড়া দেখে শিশুটি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে সবার চোখে চোখাচুখি করছে।
কুকুর যে ভিক্ষুককে কামড়িয়েছে তার স্বাক্ষী কেউ থাকতে চাইলেন না ব্যস্ত বলে। সবাই চলে গেলেন যেভাবে যাচ্ছিলেন পাঁচ মিনিট আগে এ পথে। মানব কুকুরের লড়াই দেখার আনন্দ মনে সবাই ফিরছেন বাসায়। রাতে খাবার টেবিলে বসে কেউ কেউ শুনাবেন ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফি নয় ঢাকার ফুটপাতের মানুষের জীবনের এমন গল্প। মোমেনা আক্তার লিপি আর আমি ছুটলাম হসপিটালে। সাথে আমার ছাত্র নবীন। কম্পোট হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত ডাক্তারের নির্দ্দেশ, যতদ্রুত সম্ভব ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করতে হবে। দুটো পকেট হাতিয়ে পাওয়া পঞ্চাশ টাকার প্রয়োজন পড়েনি মোমেনা আপুর ৫০০ টাকার নোটটি ছিল বলে। তার ঔষধ কেনার টাকাটা ভিক্ষুকের হাতে দিয়ে রিকশাটা ঘুরিয়ে দিলাম ঢাকা মেডিকেলের দিকে।
গন্তব্যে ছুটে চলা প্রতিটি কদমই নিজেকে পিছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি কুকুরে কামড়ানো ভিক্ষকের কাছে। আর ব্যস্ত মনকে বার বার বলছে আমি কেন শিশুটিকে কোলে নিয়ে ভিক্ষুকের পাশে রিকশায় বসে মেডিকেলে নিয়ে যাইনি?
মন্তব্যসমূহ