জাহিদ হোসেন বিপ্লবপ্রিন্ট অঅ-অ+
জাতীয় পার্টির অষ্টম কাউন্সিলে ব্যাপক শোডাউনের মাধ্যমে চমক দেখালেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। সম্মেলন সকাল ১০টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল ৮টায় সম্মেলনস্থল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। লক্ষাধিক নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে পুরো সোহওরায়ার্দী উদ্যান, শাহবাগ, মৎসভবন এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। নানা রকমের ব্যানার আর ফেস্টুনে ঢাকা পড়ে গোটা এলাকা। সকাল থেকেই বন্ধ হয়ে যায় শাহবাগ-মৎসভবন সড়ক। ফলে নগরবাসীকে পড়তে হয় যানজটের কবলে।
সকাল সাড়ে ১০টায় সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা শ্যামপুর-কদমতলী থেকে শেখ মাসুক, সুজন দে, কাওসার আহমেদ, ইব্রহিম মোল্লার নেতৃত্বে ৭/৮ হাজার নেতা-কর্মীর একটি বিশাল মিছিল সম্মেলনস্থলে প্রবেশ করতে গেলে পায়ের চাপায় পড়ে কয়েকজন আহত হন।
এরশাদের শোডাউন
নারায়নগঞ্জ থেকে লিয়াকত হোসেন খোকার নেতৃত্বে পাঁচ সহস্রাধিক লোকের একটি মিছিল সম্মেলনস্থলে এলে সভাস্থল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। ফলে আর কোনো জেলা বা উপজেলার নেতা-কর্মীরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। তখন রাস্তা এবং সোহওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থান নেন অন্যরা।
বেশিরভাগ মিছিলের সাথে ব্যান্ড পার্টি থাকায় একরকম উৎসবে রূপ নেয় সম্মেলনস্থল। সম্মেলনে ১৭টি দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এরশাদ সভামঞ্চে আসেন সকাল ১০টায়। জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সকাল সাড়ে ১০টায় সম্মেলন উদ্বোধন করেন দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এ সময় বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, জিএম কাদের, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারসহ দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এরপর বাইবেল, গীতা ও কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সম্মেলনের কার্যক্রম শুরু হয়। শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফয়সল চিশতী। দলের যে সব নেতা ইন্তেকাল করেছেন তাদের সম্মানার্থে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
পুরো অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি এবং এস এম ফয়সল চিশতী। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বেলা পৌনে ১১টায় দলের মহাসচিব সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন।
এরশাদের শোডাউন
সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে এরশাদ শুরুতেই বলেন, যারা দল ছেড়ে চলে গেছেন, তারা ফিরে আসুন। এসে দলে নেতৃত্ব দিন। এরশাদের আগে বক্তব্য রাখতে গিয়ে একই আহ্বান জানান পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ।
মঞ্চের প্রথম সারিতে এরশাদের বাঁ পাশে বসেন দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, এরপর বসেন কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের, তার পাশে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং জিয়াউদ্দিন বাবলু। অন্যদিকে এরশাদের ডান পাশে বসেন দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার, তার পাশে প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ, এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গাসহ অন্যান্য সিনিয়র নেতারা।
দীর্ঘদিনের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং তার সমর্থকরা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করায় জাতীয় পার্টির বিভক্তির অবসান হলো বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
এরশাদ তার বক্তব্যে বলেন, আমরা হারিয়ে যাইনি, আজকের এই সম্মেলন তার প্রমাণ। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা দিতেই জাতীয় পার্টির জন্ম। দেশের ক্রান্তিকালে দায়িত্ব নিয়েছিলাম। আজও সেই ক্রান্তিকাল চলছে। পেশীশক্তির ওপর ভর করে নির্বাচনে মনোনয়ন দিচ্ছে সরকারদলীয় সংগঠন। শক্তি দিয়েই জয় নিশ্চত করছে, মানুষের ভোটে নয়।
আগামী নির্বাচনে ৩’শ আসনে প্রার্থী দেয়া হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতি চলছে। এই প্রশাসন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে রাজনীতির বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এর জন্য প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা সময়ের দাবি।
বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে না দাবি করে তিনি বলেন, ক্ষমতায় যেতে পারলে এই পদ্ধতির পরিবর্তন করা হবে। সবাই জানেন কীভাবে দেশ চলছে। সন্ত্রাস, খুন, জঙ্গিবাদ, চাঁদাবাজিতে দেশ ভরে গেছে। সমাজে কেউ নিরাপদ নেই।
তিনি আরো বলেন বলেন, জাতীয় পার্টিই একমাত্র জনগণের দল। আমরাই বলছি, ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে জীবন বাঁচবে। গ্রামের সাধারণ মানুষের উন্নয়ন করতে পারলেই দেশের উন্নয়ন ঘটবে।
এরশাদের শোডাউন
রওশন এরশাদ বলেন, জনগণ জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। কিন্তু আমাদের সংগঠন শক্তিশালী নয়। দল শক্তিশালী না হলে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে না।
নেতা-কর্মীদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রওশন বলেন, তোমরা আমাদের দলের প্রাণ। বড় বড় নেতারা অনেক সুবিধা পেয়েছে, কিন্তু তোমরা কিছুই পাওনি। অথচ কষ্ট করে তোমরাই সেই দুঃসময় থেকে জাতীয় পার্টিকে আগলে রেখেছ।’
তিনি বলেন, নেতা-কর্মীরা যখন জেলে ছিল, তখনো আমাদের আসন ছিল ৩৫টি। কিন্তু আমরা সেই আসনও ধরে রাখতে পারিনি। কেন পারিনি তা চিহ্নিত করে রাজনীতি করতে হবে। সঠিক পথে রাজনীতি করা না গেলে জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হবে না।
ছাত্রদের এখনই জাতীয় রাজনীতি না করার পরামর্শ দেন সাবেক এই ফার্স্ট লেডি। তিনি বলেন, ছাত্রসমাজকে ছাত্ররাজনীতি করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে পড়াশোনা হবে না।
বক্তব্যের শেষ দিকে তিনি নেতা-কর্মীদের নিয়ে দলীয় সংগীত পরিবেশন করেন। এ সময় উপস্থিত হাজারো নেতা-কর্মী করতালি দিয়ে বিরোধী নেতাকে অভিবাদন জানান।
জিএম কাদের তার বক্তব্যে বলেন, দেশে এখন স্বার্থের রাজনীতি চলছে। এ কারণে দেশে স্বস্তিদায়ক ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ নেই। রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য নেই আশানুরূপ বিনিয়োগ। ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এ কারণে বেকার সমস্যা এখন মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, জনগণের জন্য কল্যাণমূলক রাজনীতি করতে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হয়েছে। তাই দেশের মানুষ জাতীয় পার্টির দিকে তাকিয়ে আছে। স্বার্থের রাজনীতি পরিহার করে জনকল্যাণে রাজনীতি করতে পারলে জাতীয় পার্টি জনগণের দলে পরিণত হবে।
আগামী দিনে দলের নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করে ঐক্যবদ্ধভাবে নেতা-কর্মীদের জাতীয় পার্টিকে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান জি এম কাদের।
রুহুল আমিন হাওলাদার তার বক্তব্যে বলেন, জাতীয় পার্টি গনমানুষের দল। যে দলের মাঝে আল্লাহর রহমত এবং দেশবাসীর দোয়া আছে সে দলকে কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। জাতীয় পার্টির পাশাপাশি জণগনও আজ জেগে উঠেছে। আমরা এই সম্মেলনকে শক্তি হিসেবে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার মসনদে নিয়ে জনগনের আশা আঙ্খাংকার প্রতিফলন ঘটাবো ইনশাল্লাহ।
এরশাদের বক্তব্যের পর পার্টির সংশোধনী গঠনতন্ত্র পড়ে শোনান গঠনতন্ত্র উপ-কমিটির আহবায়ক এবং চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক সচিব সুনীল শুভ রায়।
এরপর জাপার কাউন্সিলের জন্য গঠিত নির্বাচন কমিশনার শেখ সিরাজুল ইসলাম জাপার আগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে চেয়ারম্যান হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম প্রস্তাব করেন। ফয়সল চিশতি তা সমর্থণ করে। পরে উপস্থিত ডেলিগেটরা দুই হাত তুলে চেয়ারম্যান হিসেবে এরশাদকে সমর্থন দেন। একই কায়দায় দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান এবং মহাসচিব পদে রওশন এরশাদ, জিএম কাদের ও এবিএম রহুল আমিন হাওলাদারকে ডেলিগেটরা নির্বাচিত করেন।
সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য আলহাজ মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, বিরোধী দলের চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম, প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম, এম এ সাত্তার, অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম, এম এ কাসেম, অধ্যাপক মাসুদা রশীদ চৌধুরী, সাইদুর রহমান টেপা, হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, সোলাইমান আলম শেঠ, মীর আবদুস সবুর আসুদ, গোলাম হাবিব দুলাল, এসএম মান্নান, গোলাম কিবরিয়া টিপু, তাজ রহমান, এম এ কাশেম. হাফিজউদ্দিন আহমেদ, মাসুদা এমএ রশীদ চৌধুরী, অ্যাড. মহসিন, হাবিবুর রহমান, লিলি চৌধুরী এমপি, মেজর অব. খালেদ আকতার, রিন্টু আনোয়ার, অ্যাড. রেজাউল ইসলাম ভূইয়া, লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি, সেলিম উদ্দিন এমপি, ইয়াহিয়া চৌধুরী এমপি, মৌরবী ইলিয়াস এমপি, খুরশিদ জাহান হক এমপি, মমতা ওহাব এমপি, জিয়াউল হক মৃধা এমপি, মুনিম চৌধুরী বাবু এমপি, আমির ভূইয়া এমপি, সালাউদ্দিন মুক্তি এমপি, ইকবাল হোসেন রাজু, আলমগীর সিকাদার লোটন, গোলাম মোহাম্মদ রাজু, জহিরুল ইসলাম জহির, নুরুল ইসলাম নুরু, নাজমা আকতার, মোবারক হোসেন আজাদ, অন্যন্যা হোসাইন মৌসুমী, সৈয়দ ইফতেখার আহসান, মিজানুর রহমান মিরু, এএকএম আসরাফুজ্জামান খান, বেলাল হোসেন, আবু সাঈদ স্বপন, সুমন আশরাফ, হেলাল উদ্দিন সহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
বিবার্তা/বিপ্লব/যুথি
>>এরশাদ চেয়ারম্যান, হাওলাদার মহাসচিব পুনর্নির্বাচিত
মন্তব্যসমূহ