নদীতে একটা লাশ ভেসে উঠার খবর আসল। ওসি তৎক্ষণাৎ একজন এএসআই এবং কন্সটেবলকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে দিল। লাশের কাছে পৌছে তারা জানালো যে, ষাটোর্ধ এক নারীর অর্ধগলিত লাশ নদীতে ভেসে যাচ্ছে। নদীতে বেশ স্রোত, তাই লাশটিকে কৌশলে টেনে নদীর পাড়ে আনা হল।
কিছুক্ষণ পর ২জন সহোদর এসে মা'কে সনাক্ত করে হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলো। মাতৃ বিয়োগের কান্নায় ভারী হয়ে উঠলো নদীর পাড়ের পরিবেশ। শত শত দর্শনার্থীর চোখ যেন ছলছল করছিল।
৩ দিন আগে নিরুদ্দেশ হওয়া এই বৃদ্ধা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। পাশের থানায় ২ ভাই একটা হারানো জিডি করেছিল। অত:পর এভাবে মা'র গলিত লাশ দেখে তাদের মাতম থামানো দায় হয়ে উঠে।
এই সহোদরের শোক ছাপিয়ে পাশেই ঘটছে আর এক বাস্তব কিন্তু অপ্রিয় সত্য ঘটনা। এই গলিত লাশ পানি থেকে তোলে নিয়ে যেতে হবে সদর হাসপাতালে পোস্টমর্টেম করাতে। পুলিশ কেইস বলে কথা।
লাশের গন্ধে কেউ ১০/১২মিনিটের বেশি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা। এই অবস্থায় লাশটি জল থেকে ডাঙ্গায় কে উঠাবে?.... 'এএসআই বস'-এর হুকুমে কন্সটেবল ব্যাটা এরই মধ্যে লাশের কাছে দু'বার গিয়ে প্রকট গন্ধে বমি করে ফিরেছে। পুলিশ ডাকলে 'না' বলতে হবে, এই ভয়ে ৮০% দর্শনার্থী ইতোমধ্যে পলায়ন করেছে। বাকি যারা রয়েছে তারাও এই কাজে অক্ষম- নারী, শিশু আর বৃদ্ধ। বাকী রইল এএসআই সাহেব আর লাশের মালিক ২ভাই।
এএসআই প্রথম থেকেই নাকে রুমাল বেধে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই তারপক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। নিরুপায় এই পুলিশের এএসআই, লজ্জায় শোকার্ত ভাইদের কাছেও অনুরোধ করতে পারছে না। অবশেষে মোবাইল ফোনে এক মেথরকে ডেকে এনে ৫ শত টাকার বাঙলা মদের একটা বোতলের ব্যবস্থা করে দিল। মেথর ব্যাটা ব্যাপক মটিভেশিন নিয়ে লাশটি নিয়ে টানাটানি শুরু করলেও ৮/১০ফুট উচু নদীর পাড়ে উঠাতে ব্যর্থ হলো। ১০ মিনিট টানাটানির পর মেথর লোকটি হাপিয়ে উঠল।
রাগ, বিরক্তি আর ওসি'র বকার ভয়ে এএসআই'এর মধ্যে বুদ্ধিহীনতা দেখা দিল। সে সহোদর ভাইদের অনুরোধ করে বসলো লাশটিকে টেনে ডাঙ্গায় উঠাতে। সহোদরদ্বয় এবার কান্না থামিয়ে নাকের পানি আর চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালো। তারা লাশের কাছে গিয়ে আবার দৌড়ে ডাঙ্গায় উঠে এল। বমিতে চোখমুখ উল্টে গেল কিন্তু বমি করলো না। দু'ভাই ফ্যাল ফ্যাল করে পুলিশের দু'সদস্যের দিকে তাকিয়ে রইল। এমতাবস্থায় তাদের কান্নাও থেমে গেল। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হল এবার পুলিশের ২ সদস্যই কান্নাকাটি শুরু করবে।
জগতের সব অস্বস্তি ভুলে নাকমুখ রুমালে চেপে মেথরকে সাথে নিয়ে লাশটি উঠাতে এএসআই নিজেই পানিতে নেমে গেল। অনেক কষ্টে অবশেষে লাশটি ভ্যানে উঠানো হলো। কিন্তু সমস্যা আরও রয়ে গেল:
-হাসাপাতাল ১০/১২ কি:মি: দূরে, লাশ নিয়ে ভ্যানের সাথে কে যাবে?
-মেথরকে আরও ১ বোতল বাঙলা মদের দাম কে দিবে?
-ভ্যানে করে লাশ আনা-নেয়ার ভাড়া কে দিবে?
-লাশকাটা ঘরের ডোমকে ১ বোতল বাঙলা মদ কে দিবে?
দুই সহোদর সাফ সাফ জানিয়ে দিল, এটা তাদের দায়িত্ব না, পুলিশের দায়িত্ব। কথা সঠিক, টাকা পুলিশকেই দিতে হবে। কারন পুলিশ কেইসের লাশ পুলিশকেই হ্যান্ডেল করতে হবে। কিন্তু, কথা সেখানে না। কথা হচ্ছে: " পুলিশের কাছে এটা একটা লাশ, কিন্তু সন্তানের কাছেও কি এই 'মা'টা শধুই একটা লাশ?"
দুই পুলিশ ভ্যানের দু'পাশে বসে ঠ্যাং দু'টা ঝুলিয়ে সদর হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিল। পুলিশের মোটরসাইকেল জমা রইলো গ্রামের এক কৃষকের বাড়িতে, আর সহোদরের বাইকটা শা শা করে ধূলো উড়িয়ে ছুটে চলল অনাড়ম্বরভাবে মা'র দাফন কাফনের ব্যবস্থা করতে।
এরকম হাজারও পরিস্থিতিতে এই এএসআই'দের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেথর শ্রেণিভুক্ত হতে হয়। এত কিছুর মাঝেও এরকম কিছু দায়িত্ব পালনের নজির দেখে পুলিশের চাকুরিই আমাদের সবচেয়ে মুগ্ধ করে।
(ঘটনাটি ২০০৭ সালের। আমি তখন শিক্ষানবিশ সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বাস্তব প্রশিক্ষণ গ্রহনের উদ্দেশ্য মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর থানায় সংযুক্ত ছিলাম।...... )
লেখক: কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) বোম্ব ডিস্পোজাল টিমের প্রধান ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি), গোয়েন্দা শাখা, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
মন্তব্যসমূহ