তুই কই গেলিরে মা..


তনুর বাবা-মার বুকফাটা আর্তনাদ
. জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল, জেলা প্রতিনিধি কুমিল্লা : সোহাগী জাহান তনুদের গ্রামের বাড়ি জেলার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা পশ্চিম ইউনিয়নের মির্জাপুরে। সেই গ্রামজুড়ে এখন চলছে শোকের মাতম। 
বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মনসুর উদ্দিন এবং সহকারি কমিশনার (ভূমি) আজগর আলী। তনুর কবর জিয়ারত করে পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন তারা।
ইউএনও’কে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বুক ফাটা আর্তনাদ শুরু করেন তনুর বাবা-মা ও স্বজনরা। 
তনু হত্যার বিচার দাবিতে রাজপথের পাশাপাশি ফেসবুকেও ঝড় বইছে। সাইফুল্লাহ খালেদ নামে এক তার ওয়ালে লিখেছেন আবেগঘণ এক স্ট্যাটাস।
তিনি লিখেছেন, ‘সেই তনু এখানে ঘুমিয়ে আছে। বাড়ি থেকে প্রায় ২০ মিনিট পায়ে হেঁটে যেতে হয় তার কবরপ্রাঙ্গণে। রাস্তারে পাশে একটি বিল তার মাঝে একটি উচুঁ ডিবিতে শুয়ে আছে ইয়ার হোসেনের বুকের ধন সোহাগী। আকাশে চাঁদের আলোয় সবুজ মাঠগুলো নরম বিছানার মতো দেখতে। কি ফুরফুরে বাতাস বইছে। হয়তো সোহাগী এখানে শুয়ে আছে তাই।
হাঁটতে হাঁটতে কাঁপা কণ্ঠে ইয়ার হোসেন (তনুর বাবা) বলছেন, বাবা আমার জেঠি আদর করে তার নাম রেখেছিল সোহাগী। সবাই তাকে আদর করতো। আমি আমার মাকে বলতাম মা তোরে আমি বুকের মধ্যে আটকে রাখতে চাই। মেয়েটাকে বুকে টেনে নিতাম। সে বলতো বাবা, আমি তো বড় হয়েছি। তুমি কি পারবে আমাকে সবসময় বুকে রাখতে।
সত্তোর্ধ এক বৃদ্ধ বললেন, ইয়ার হোসেন শহরে চাকরি করে (কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী)। মেয়েটা সবার ছোট। গ্রামে আসতো বছরে একবার। আমরা বলতাম এই মেয়ে একদিন অনেক বড় অফিসার হবে। ...বলতে বলতে গলা বসে গেল বোবাকান্নায়। চোখ মুছতে মুছতে বলছেন... আল্লাহ তুমি এর বিচার করো।

বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় তনু

প্রতিদিন মির্জানগরের এ পথ ধরে যারা হেঁটে যাবেন তারা হয়তো ক’দিন পরই ভুলে যাবেন বিলের পরে ওই কবরখানায় শুয়ে আছে নেকড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত এক কিশোরী। বোন তনু তোর চোখের দিকে তাকালে আমার চোখ ছল ছল করে ওঠে। আমার বোনটির বাসায় ফিরতে দেরি হলে আব্বা আমাকে বলতেন যাওতো ও এখনওতো এলো না। ঠিক তেমনি সেদিন প্রাইভেট পরিয়ে তুই আর বাসায় ফিরলি না। এরপর থেকে তোর বাবা মা পাগলের মতো ছুটছে। তোর মা এখন প্রতিরাতে তোকে স্বপ্নে দেখে। তুই পুরস্কার আনার জন্য যে দুটো নতুন জামা আনতে বলেছিলি মা সেগুলো নিয়ে এসেছে। 
তনু, ফেলানীরা শকুনের ছোবলে ক্ষত বিক্ষত হয়। জাগিয়ে দিয়ে যায় আমাদের অন্তরাত্মাকে। কতক্ষণ কতদিন...। 
কান্নায় কথা বলতে পারছিলেন না তনুর মা। শুধুই বিলাপ করছেন... জননীগো... আমি বাসায় গেলে কে থাকবে আমার পাশে। তুই কই গেলিরে মা...। এই মা’কে শান্তনা দেবে কে? কেউ কি পারবে তার প্রিয় সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে।
রুবেল এগিয়ে এসে মা’কে থামাতে চাইলো। মাকে জড়িয়ে নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো ছেলেটি। রুবেল বললো, এইতো ক’দিন আগে আমি আপু আম্মু একসাথে ছবি তুলেছি আপুর বার্থ ডে ছিল। আমরা কত মজা করতাম। আপু খুব আদর করতো আমাকে। 
রুবেল যখন কথা বলছিল। পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিল গ্রামেরই কিছু মহিলা। বলা নেই কওয়া নেই.. তাদের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুজল। আসলে তনু চলে গিয়ে সবার আপন হয়ে রয়ে গেল।
কিছুটা শান্ত হয়ে এলে মা জানালেন, সেই ছোটবেলা থেকের ভিক্টোরিয়ায় অনার্স পর্যন্ত পড়তে গিয়ে কত পুরস্কার যে পেয়েছে তনু। ভালো গান গায় তাই সব অনুষ্ঠানে তাকে ডাকতো। কত স্টুডেন্ট ছিল তার। 
মাগরেবের পর গ্রামের মানুষগুলো দলবেঁধে গেলো কবর জেয়ারত করতে। তারপর সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে নানা জনের নানা ক্ষোভ শুনলাম। কারো কারো আক্ষেপ এই গ্রামকে আলোকিত করতো মেয়েছি। অনেক বড় হবে সে- আমরা তাই ভাবছিলাম। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। 
একটি দরিদ্র পরিবার গ্রাম থেকে শহরে এসেছে। নিরাপত্তার চাদরে বেড়ে উঠা শহুরে সভ্যতায় সে কি অসভ্যতা- তা কে জানতো। গ্রামের মেয়েরা ক’জনই বা অনার্স পড়তে পারে। তার মাঝে একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রদীপ হিসেবে জ্বলে উঠছিল তনু। শুধু লেখাপড়াই নয়, মেধা মননে মেলে ধরেছিল সুপ্ত প্রতিভা। কিন্তু থেমে গেছে সব। জীবন সবারই থেমে যায়। কিন্তু কিছু থেমে যাওয়া রয়ে যায় দু:স্বপ্নের মতো। তনুর বাবা বলছিলেন, মেয়েটা একা একা কলেজে যায়। আমি ভয় পেতাম। তনু আমাকে সাহস দিতো। আজ সেই মেয়ে আমার মেয়েকে বাসার পাশেই....।
ফেসবুকে বসলেই দেখি তনুর হিজাবে ঢাকা মুখাবয়বে তনুর মিষ্ঠি আভা যেন আলো ছড়াচ্ছে। সবাই সবাই সবাই এ ঘৃণ্য হত্যার বিচার চায়। আসলেই কি সবাই চায়। না এটা আমার আবেগের কথা। সবাই চায় না বলেই তনুরা ক্ষতবিক্ষত হয়ে জমিনের পড়ে পরে থাকে। 
তনু ক’দিন আগে ফেসবুকে লিখেছিল- আমাকে আমার মতো থাকতো দাও... / আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি। সত্যিই যেন তাই। বিলের ধারে শুয়ে আছে মেয়েটি। আর এদিকে কত ঝড়ই না বইছে। এ যেন শুস্ক মরুর লু হাওয়া। রাতের চাঁদের আলোয় মানুষের সারি চলছিল সামনের দিকে। দাড়িয়ে দাড়িয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই কি আমরা আমাদের প্রতিটি বোনকে এ সমাজে নিরাপদ চলতে দিচ্ছি। 
কোথায় খুন হয়েছে, সেটার চাইতে বড় কথা হলো পুরুষত্ব জাহির করতে আসা কোন নেকড়ের সামনে পড়েছিল হরিনীটি। নেকড়েরা সব জায়গায় বাস করে। শুধু শিকার পেলেই রক্তাক্ত করে নখড়াঘাতে। 
মৃত্যুর চারদিন আগে তনু লিখেছিল মান্না’দের গানের দুটি কলি... ‘সবাই তো সুখী হতে চায়/.. তবে কেউ সুখী হয় কেউ হয় না।’... হ্যাঁ এটাই সত্যি।”
নিহতের স্বজনরা জানান, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইতিহাস বিভাগের (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী ও ভিক্টোরিয়া কলেজ অথুনা থিয়েটারের সদস্য সোহাগী জাহান তনু গত রোববার সন্ধ্যায় প্রাইভেট পড়ানোর জন্য বের হয়। রাত গড়িয়ে গেলেও বাসায় ফিরে না আসায় তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে পরিবারের সদস্যরা। রাতে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন কালভার্টের পাশে ঝোপের মধ্যে তার লাশ পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে পরদিন কোতোয়ালী মডেল থানায় অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের নামে হত্যা মামলা করেন।

মন্তব্যসমূহ