পীর হাবিবুর রহমান-
পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আবেগ-অনুভূতি নিয়ে নির্বাসিত ও বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন লিখলো- ‘শেখ হাসিনার চোখের চরিত্র আমাদের চোখের চরিত্রের মতো নয়। হাসিনার চোখ দিয়ে সুখে জল বেরোয়, দুঃখে বেরোয় না। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল জিতে গেলে বেরোয়। বাংলাদেশের ব্লগারদের কুপিয়ে মেরে ফেললে বেরোয় না। অবশ্য প্রশ্ন থেকে যায়, কুপিয়ে মেরে ফেলার ঘটনাগুলোয় আদৌ তিনি দুঃখটুঃখ কিছু পান কি না”। এই কথাগুলি বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের।
শেখ হাসিনার রাজনীতি ও শাসনব্যাবস্থার সমালোচনা করা যায়, কিন্তু উনার সৌন্দর্য্যের বড় দিকগুলোর একটি হলো দেশের ছেলেদের মাঠে গিয়ে উৎসাহই দেননা, হৃদয় দিয়ে, মন দিয়ে সমর্থন দেন। আবেগে লাফ দিয়ে উঠেন, হাততালি দেন সাকিব মাশরাফিরা ছক্কা হাকালে। উইকেট পড়লে বিষাদ। চরম উত্তেজনার ম্যাচে জেতায় আনন্দাশ্র“ সবার হয়ে তার চোখে গড়ায়। ৭৫এ হারিয়েছেন পিতাও জাতির জনক সহ পরিবারের সব। তবু তসলিমা বুঝেনা! তখন সে বিচিত্রার ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনের পাতায়। এখন সে নিরাপদে পার্ট টাইম পুরুষ শিকার করে। মাতৃত্বের মমতা বুঝেনি বলে, বুঝেনা একুশের গ্রেনেড হামলা কত ভয়াবহ! তাই এ নিয়ে তার লেখা নেই। নষ্টভ্রষ্ট তসলিমা বুঝেইনা মানুষের মৃত্যু কত বেদনার। মানুষের ধর্মীয় অনুভুতি আঘাত আর বাবর আলীর গোঙ্গানিতেই তার পৈশাচিক আনন্দ। তসলিমা নিজেই নিজের লজ্জা, বেহায়া বিতর্ক বুঝে, পুরুষের শয্যা বুঝে, নিজের খ্যতিই বুঝে! অসভ্যতাই বুঝে। বুঝেনা কেবল মানুষ দেশ আর খেশ। বুঝে শুধু নিজের জীবন উপভোগ, নিন্দিত হলেও প্রচার। তসলিমা নারী হতে পারেনি, বাঙালী কি আদৌ হয়েছে? মূল্যবোধ লাজ শরম ডিকশনারীতে নাই থাকুক মানুষকি হতে পারলো! সেদিন আনন্দ অশ্র“ অনেকেরই ঝরেছে, এটাই আবেগ, এটাই মমতা, দেশপ্রেম থাকলেনা তসলিমা বুঝবে!!
এর আগেও তসলিমা নাসরিন আলোচনা তৈরীর জন্য অনেক গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিদের নামে বিভিণ্ন আপত্তিকর মন্তব্য করেছে। বিখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে তসলিমা লিখেছিলো ‘সুনীল একরাতে তার বন্ধুদের সঙ্গে খাবার খেয়ে হোটেল ঘর থেকে ফিরে যাওয়ার সময় তার গায়ে অশ্লীলভাবে হাত দিয়েছিলেন’।
তখন আমি লিখেছিলাম-
‘বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন কতটা অশ্লীল? এমন প্রশ্ন বার বার মানুষের মধ্যে জন্ম দিয়েছে। শালীনতার নেকাব খুলে অশ্লীলতার সিঁড়ি অতিক্রম করতে করতে এ পর্যন্ত আসা তসলিমা এবার আকস্মিক বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে। মানুষ যখন ব্যথিত হয়, তখন পৈশাচিক আনন্দ লাভ তসলিমার স্বভাব। তসলিমা টুইটারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ভ- বলেই থামেননি, তার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ এনেছেন। তিনি প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের বলেছেন, সুনীল একরাতে তার বন্ধুদের সঙ্গে খাবার খেয়ে হোটেল ঘর থেকে ফিরে যাওয়ার সময় তার গায়ে অশ্লীলভাবে হাত দিয়েছিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তসলিমা নাকি এতটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন যে, কী করবেন ভেবে পাননি। পরে এ ঘটনা নিয়ে তসলিমা নাকি ‘রাস্তার ছেলে এবং কবি’ নামে একটা কবিতা লিখেছিলেন। তসলিমার দাবি কবিতাটি সুনীলকে নিয়ে লেখা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তসলিমার ফালতু কথাকে হাস্যকর বলে উড়িয়েই দেননি, প্রশ্ন তুলেছেন ব্যাপারটি নিয়ে তসলিমা এত দিন চুপ ছিলেন কেন? সুনীল যথার্থই বলেছেন। তসলিমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। আসলে হইচই বাধিয়ে প্রচারের আলোয় আসতে চান বলেই এসব উল্টাপাল্টা যা খুশি বলছেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্যকে হৃদয় অনুভূতি দিয়ে বিশ্বাস করা গেলেও কোনো যুক্তিতেই তসলিমা নাসরিনকে বিশ্বাস করা যায় না। বিশ্বাসের জায়গা বহু আগেই তসলিমা হারিয়েছেন। নির্বাসিত হয়েছেন। জীবনের প্রথম তারুণ্যেই তসলিমা আৎদপ্রচারে অর্থ খরচ করে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনে নাম লিখিয়েছিলেন। পয়সা খরচ করে পরিচিতি লাভের নেশাটিও তার পুরনো। এ দেশের তারুণ্যের কাছে যখন কবিতা ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে তখন এই তসলিমা নাসরিন কবিদের গায়ে গায়ে ভাব জমিয়ে দিনে দিনে কবি হয়ে উঠেছিলেন। তসলিমা নাসরিন যখন গদ্য লেখা শুরু করলেন তখন রাস্তার ফুটপাত থেকে আরিচা ফেরিঘাট হয়ে রসময় গুপ্তদের গোপন সব অশ্লীল রচনা বিদায় হতে থাকল। এরশাদ জমানায় আমরা যখন দৈনিক পত্রিকা ছাড়াও সাপ্তাহিক বিচিন্তা, যায়যায়দিন, খবরের কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিয়মিত পড়তাম তখন আমাদের এক বন্ধু তাতে কোনো আগ্রহ দেখাত না। হঠাৎ একদিন লাজুক স্বভাবের বর্তমান লন্ডনপ্রবাসী ওদুদের হাতে দেখা গেল সাপ্তাহিক খবরের কাগজ। অনেক জেরার পর লাজুক মুখে সে বলেছিল, তসলিমা নাসরিনের কলাম পড়ার জন্যই সে এখন এটা নিয়মিত কেনে। তসলিমা তখন ময়মনসিংহ শহরে সিনেমা দেখে ফেরার সময় কোন বখাটে একটু চাপ দিল, জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিল তা প্রতিবাদের ছলে রগরগে করে সুড়সুড়ি দিয়ে লিখতেন। তসলিমার সব লেখায় যৌন সুড়সুড়ি, উসকানি ও আক্রমণ, আঘাত প্রাধান্য পেয়েছে। তসলিমা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করছেন। তার ‘লজ্জা’ পাঠকের কাছে মূল্যহীন হলেও দেশের মানুষের মনে আঘাত দিয়েছে। ভারতের মৌলবাদীরা লুটেছিল ফায়দা। এ দেশের মৌলবাদীরা তাকে দেশছাড়া করেছিল রাস্তায় জিহাদি মিছিল করে। সেই তসলিমা নাসরিন তার আৎদজীবনী ‘ক’ প্রকাশ করে এই মৌলবাদীদের মুখে তুলে দিয়েছিলেন তৃপ্তির হাসি। মুর্তাদের হাতে দেশের প্রগতিশীল লেখক, বুদ্ধিজীবীদের চরিত্রহননের রগরগে কাহিনী পড়ে তারা হেসেছে আমোদে। ‘ক’ নিয়ে মহান সংসদেও প্রবীণেরা রসাৎদক আলোচনা করেছেন। দুই বাংলার যেসব বরেণ্য লেখক ভরা যৌবনের তসলিমা নাসরিনের উষ্ণ সান্নিধ্য লাভ করে উপরে ওঠার সিঁড়ি ধরিয়ে দিয়েছিলেন তারা তখন যার যার মতো উচ্চ আদালতে গেছেন মানহানির মামলা নিয়ে। অন্যদিকে তসলিমার যৌন জীবনীমূূলক ‘ক’-এ অনেকের সঙ্গে তার রাত কাটানো ও শরীর বিনিময়ের কেচ্ছা-কাহিনী ছাপা হওয়ায় তা বাংলাবাজার থেকে রাস্তায় রাস্তায় হকারদের হাতে উঠে আসে। শেষ পর্যন্ত বইটির বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও, তসলিমা নাসরিনের চরিত্র সাধারণের কাছে নষ্ট মেয়েমানুষ বলে চিত্রিত হলেও বিক্রি যেমন ভালো হয়েছে, তেমনি আলোচনায় আসার সাফল্য তাকে তৃপ্তি দিয়েছে। এতে বাঙালির মূল্যবোধ, পরিবার-সমাজের স্নেহ-ভালোবাসার প্রীতিময় বন্ধন ও রুচিকে অস্বীকার করে নিজের কথা ভাবা তসলিমার রচনা বাপ-ছেলে মিলে পড়তে পারেননি। তসলিমা নাসরিনের ‘ক’ বের হওয়ার পর কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘অর্ধসত্য’ ননফিকশনটি পাঠকপ্রিয়তা পায়। মিডিয়া নিয়ে লেখা বইখানি লেখকের দর্শনকেই ফুটিয়ে তোলেনি, যুক্তিনির্ভর ঝরঝরে তথ্যবহুল গদ্যের সমাহারে ইতিহাসের উপাদান হয়ে আছে পাঠকের ঘরে। কবি-সাংবাদিক আবু হাসান শাহরিয়ারই আমাকে গদ্য লেখায় উৎসাহিত করেছিলেন। কলাম লেখা ও বই প্রকাশের উৎসাহও তার কাছে। আমার দেখা তিনি একজন উঁচুমানের মেধাবী লেখকই নন, শক্তিমান কবিই নন, একজন সৎ, সাহসী মানুষও বটে। তার মাথায় মিডিয়া নিয়ে নিত্যনতুন যত সব আইডিয়া। তসলিমা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার সুবাদে আবু হাসান শাহরিয়ারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। আবু হাসান শাহরিয়ারের হাত ধরেই কলাম লিখতে শুরু করেছিলেন খবরের কাগজে। শাহরিয়ারের অর্ধসত্যে ফুটে উঠেছে তার জন্য একজন তসলিমা নাসরিনের তৃষ্ণা, প্রেম ও ভালোবাসার আকুতি কতটা তীব্র ছিল। অনেকেই যেখানে দুর্বল হয়েছেন শাহরিয়ার সেখানে মনিরা কায়েসের জন্যই হোক আর তার আৎদসংযম ও মূল্যবোধের কারণে হোক, রীতিমতো বেঁচে গেছেন। তার প্রতি তসলিমার আগ্রাসী হাত বাড়ানোর বহু তথ্য-প্রমাণ সাহিত্য বিকাশ প্রকাশিত অর্ধসত্যে পাওয়া যায়। তসলিমা একসময় শাহরিয়ারের কবিতার ন্যুড মডেলও হতে চেয়েছিলেন। শাহরিয়ারের কাব্যগ্রন্থ হাতে নিয়ে তসলিমা এক রিল ছবিই ওঠাননি, সুখ সুখ স্বপ্ন স্বপ্ন লেখা আঁকিবুঁকি কাগজ, প্রেমের আকুতিভরা চিঠি ও তার হাতে আঁকা স্কেচ পর্যন্ত দিয়েছিলেন। সাহিত্যমূল্যে সৈয়দ শামসুল হকের অসাধারণ সব গ্রন্থের কথা বাদ দিয়ে তসলিমা খেলারাম খেলে যা নিয়েই টানাহেঁচড়া করেছিলেন। তার মনের ভেতর জুড়ে পুষে রাখা নায়কের নাম হয়তো বাবর আলী বলেই। তসলিমা নাসরিনের বন্ধুভাগ্য ভালো। এক বন্ধু তার কাগজে লেখার অবাধ সুযোগ দিয়ে পরিচিতি এনে দিয়েছিলেন। ভীষণ ভালোবেসে বিয়েও করেছিলেন। সংসার ভাঙার পর তার ছেড়ে আসা স্বামীর নিতম্ব নিয়ে তসলিমা কটাক্ষ করেছেন ‘ক’-এ। মানসিক বিকৃতির এই ধারায় যে বন্ধু দুই বাংলার কবিদের নিয়ে সম্পাদিত গ্রন্থে মানবিচারে তসলিমার কবিতা ঠাঁই দেননি তাকে তিনি শেওড়া গাছের ভূত বলে আক্রমণ করেছেন। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবাধ স্বাধীনতা ও যৌনতার পথে হাঁটা তসলিমা নাসরিন বার বার পুরুষের বাহুলগ্না হয়েছেন বৈধ-অবৈধ সব পথেই। যারা বাহুলগ্না করেছেন তাদের জীবন ভাঙা গাড়ির মতো লক্কড়-ঝক্কড় হয়ে ক্ষয়ে গেলেও তারা খোলা মনে তাকে হয় ক্ষমা করেছেন, না হয় তাকে নিয়ে কথা বলতে রুচিতে বেঁধেছে। তসলিমা উপরে ওঠার প্রজেক্ট পরিচালক মনে করে ভালোবাসার নামে যাদের বিয়ে করেছিলেন তাদের একজন অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। আরেকজন আৎদহননের পথ নিয়েছেন অকালেই। বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় এ দুজন কিংবদন্তি হলেও তসলিমা আজ অবধি বিতর্কিতই থেকে গেছেন। আরেকজন টিকে গেলেও তার জন্য তার মিডিয়ার দুয়ার খুলে রেখেছেন। একজন জনপ্রতিনিধি অল্পতেই হারিয়ে গেছেন।
তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে এরশাদ আমলে একুশে বইমেলায় আমার এক বন্ধু পরিচয় করিয়ে দিলেও আল্লাহর অশেষ রহমতে তার সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। সবাই তসলিমার রচনার প্রতি মুখ ঘুরিয়ে নেন বলে তিনি মানুষের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি করেন। তার নিজের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নেই বলে, পারিবারিক জীবন বলে কোনো সুখময় ক্যানভাস তৈরি হয়নি বলে, মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে আক্রমণ করে দুঃসহ করে তুলে আনন্দ পান। নিজেকে আলোচনায় রাখতে ও আনতে তসলিমা কোনো কিছুর ধার ধারেন না। অতি সম্প্রতি সুনীলকে আঘাত করার আগে দেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ দেশবাসীকে কাঁদিয়ে বিদায় নিলে তসলিমা ঈর্ষার অনলে পুড়ে মৃতকে আঘাত করার সুযোগও ছাড়েননি। হুমায়ূন আহমেদের পাঠকপ্রিয়তায় ঈর্ষাকাতর তসলিমা বলেছেন, এ দেশের পাঠক মূর্খ তাই হুমায়ূনের বইয়ের বেশি কাটতি। এটা তার হিংসা-বিদ্বেষ প্রসূত গণবিরোধী কথা ছাড়া কিছু নেই। ওপার বাংলায়ও হুমায়ূনের কাটতি প্রবল ছিল। তসলিমার মৃত্যুতে তার লেখায় আঘাত পাওয়া বন্ধু-স্বজন ছাড়া অশ্র“সিক্ত হবেন, কাঁদবেন এমন মানুষ পাওয়া যাবে তেমন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। নির্বাসিত লেখক দাউদ হায়দারের জন্য অগণিত পাঠক ও মানুষের মন কাঁদলেও তসলিমার জন্য কাঁদে না। তসলিমা নাসরিন রাজনৈতিক নেতানেত্রী, নারীনেত্রী কাউকেই ছাড়েননি। তার অন্তরজ্বালা হচ্ছে কেউ তার পাশে দাঁড়াননি। তসলিমা যদি অরুন্ধতী রায় হয়ে উঠতেন, তাহলে তার জন্য লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক নেতানেত্রী ও নারীনেত্রীরা রাস্তায় নামতেন। সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহিম থেকে আজকের আয়েশা খানম পর্যন্ত নারীনেত্রীরা অসহায় বিপন্ন নারীর পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছেন, তসলিমাকে কোথাও সেভাবে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। তসলিমা কোথাও বিপন্ন মানুষের জন্য লড়েন না। তিনি মানুষের কথা ভাবেন না। ভাবেন নিজের কথা। নিজেকে আলোচনার মধ্য দিয়ে দেশ থেকে বিদেশ এমনকি পশ্চিমাদের কাছে নিয়ে যেতে তার বাপের চরিত্র নিয়েও টানাটানি করতে ছাড়েননি; বন্ধু, স্বামী, স্বজন, বরেণ্য লেখকেরা ছাড় পাবেন কীভাবে? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে তসলিমা যেভাবে আক্রমণ করেছেন তার একটি শব্দ যদি সত্য হতো তা রাঙিয়ে তিনি এক ফর্মা লেখা ‘ক’-তেই লিখতেন। তসলিমা নাসরিন যদিও বলেছেন তার ‘দ্বিখ-িত’ নিষিদ্ধ করার পেছনে পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকারের প্রতি সুনীলের ইশারা ছিল, তবু তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সত্য হলে তসলিমা তখনই বলতেন। বহু দিন তসলিমা সুনীলদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন উপরে ওঠার জন্য। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের আইপিএস অফিসার নজরুল ইসলামের লেখা ‘মুসলমানদের করণীয়’ নামের একটি বই সম্পর্কে প্রশাসনের কঠোর মনোভাবের বিরুদ্ধে সুনীল কোনো বই নিষিদ্ধ না করার পক্ষে মত দেওয়ার পর তসলিমা জ্বলে ওঠেন। হায়দরাবাদ থেকে পশ্চিমবঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের একটি উগ্র অংশের তাড়া খাওয়া তসলিমাকে উদার গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত সরকার দিল্লির অজ্ঞাত স্থানে নিরাপত্তা সুরক্ষায় রাখলেও নানা অসুখ-বিসুখ, একাকিত্ব ভর করা আর ভীষণ মুটিয়ে যাওয়া চেহারার জৌলুস হারানো তসলিমাকে নিঃসঙ্গতা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। বন্ধু-বান্ধব, কবি-সাহিত্যিকেরা তার জন্য মাঠে লড়া দূরে থাক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার কারণে মানসিক শক্তি হারিয়ে এই আক্রমণ করেছেন। বর্তমানে ইউরোপে থাকা তসলিমা নাসরিন কলকাতায় ফিরতে চান। কলকাতাকে তার দ্বিতীয় ঘর মনে করেন। কিন্তু এত বিতর্কের ভারী বোঝা বহন করার দায় না নেওয়ার অপরাধে তিনি সুনীলকে আক্রমণ করেছেন। বাংলাদেশে মৌলবাদীই নয়, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত করার অপরাধে সরকার যেমন তসলিমাকে তার দেশে আসার সুযোগ করে দিতে রাজি হয় না, তেমনি তার অশালীন, অশোভন আক্রমণের শিকার কবি-সাহিত্যিকেরাও তাকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে মাঠে নামেন না। তার রচনা পাঠকদের হৃদয় জয় করতে পারেনি বলে মানুষও তাকে নিয়ে ভাবে না।
তসলিমা নাসরিনের মাথার দাম ৫০ হাজার টাকা দাবি করেছিলেন সিলেটের ইসলামী ঐক্যজোট নেতা প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান। তখন আমি বাংলাবাজার পত্রিকায়। মাওলানা হাবিবুর রহমানের এ ঘোষণার ঘোর বিরোধী আমি এখনো। আমি মানুষের লেখা ও বলার স্বাধীনতার পক্ষে। এমনকি নির্বাসিত তসলিমা নাসরিনসহ অন্যেরা তাদের জন্মভূমিতে ফিরে আসুন সেটিও চাই। কিন্তু একজন আল্লাহভীরু, রাসূল (সা.)-অনুসারী মুসলমান হিসেবে কোরআন নিয়ে তসলিমার কটাক্ষ ও সমালোচনার প্রতিবাদ করি। তার ওপর হামলা পছন্দ করি না। তার ক্ষেত্রেও অভিযোগ থাকলে আইনগত বিচার চাই। ‘৭১-এ স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম উচ্চ আদালতের রায়ে নাগরিকত্ব নিয়ে দেশে বসবাসের অধিকার পেলে অন্যেরা কেন পাবেন নাথ এ প্রশ্ন আমার মাথায় সব সময় ঘুরপাক খায়।
২০০৭ সালে উগ্র হয়ে ওঠা মুসলমানদের তাড়া খেয়ে তসলিমা নাসরিন যখন কড়া নিরাপত্তায় গুটিসুটি মেরে ঘরে বসে আছেন তখন আমিও বউ-বাচ্চা নিয়ে কলকাতায়। সংবাদকর্মী সুব্রত আচার্য দেখা করতে এসেছেন। গল্পে গল্পে তার কাছ থেকে তসলিমা নাসরিনের টেলিফোন নম্বর নিয়ে কৌতূহলবশত ফোন করলাম। আমার জীবনসঙ্গিনী ডায়না নাজনিনের এতে রেগে না ওঠায় অনেকটাই অবাক হলাম। ও প্রান্তে তসলিমা টেলিফোন ধরে কে জানতে চাইলে শুধু বললাম, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি পীর হাবিবুর রহমান। বুঝতে পারলাম তসলিমা নির্বাক। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বললাম, আমি সিলেটের মাওলানা হাবিবুর রহমান নই। আপনি কেমন আছেন? তসলিমার উত্তরথ আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। আপনার সঙ্গে কেন কথা বলব? ভয়ার্ত কণ্ঠেই তিনি উত্তর দিলেন। আমি ফের বললাম, আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের আমি স্নেহভাজন। তসলিমা নিরুত্তর। ফের বললাম, আমি নাইমুল ইসলাম খানেরও স্নেহভাজন। ভাবলাম এবার বুঝি তসলিমা কথা বলবেন। তসলিমা উত্তরে বললেন, আমি আপনার সঙ্গে কোনো কথাই বলব না। মাওলানা হাবিবুর রহমান একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তসলিমা নাসরিন লাগামছাড়া রমণী। তার লাগাম টেনে ধরতে হবে। মাওলানা হাবিবুর রহমানের সঙ্গে একমত হইনি। মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী আমি। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা, উপন্যাস পড়ে মুগ্ধ হয়ে তার ভক্ত হয়েছি সেই বরেণ্য লেখক সম্পর্কে তসলিমা নাসরিনের তথ্য-প্রমাণহীন আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজ বলতেই হয়থ লাগাম থাকলে তসলিমা মানুষের বিচারে নষ্ট মেয়েমানুষ হিসেবে চিহ্নিত হতেন না। হয় মানুষ, না হয় শাশ্বত বাঙালি নারীই হতেন। তসলিমার অভিধানে বা চরিত্রের কোথাও শালীনতাবোধ মানে শালীনতার নেকাব দেখা যায়নি। দেখা যাবে বলে কেউ আর বিশ্বাসও করেন না। ‘ক’-এ প্রথম যৌবনে তসলিমা অনেকের শয্যাসঙ্গী হওয়ার রগরগে বর্ণনা থেকে কোনো পাহাড়ি জনপদের বাংলোয় বাবর আলীর মধ্যরাতের গোঙানি শোনার কাহিনী তুলে ধরেছেন। তসলিমাকে কেউ জোর করে কোথাও নিয়ে যায়নি। তিনি নিজেই গেছেন, একেক জনকে নিজেই শয্যায় টেনেছেন। যারা ভোগ করে সরে গেছেন তাদেরও আক্রমণ করেছেন, যারা ভোগের আমন্ত্রণে সাড়া দেননি তাদেরও তাড়া করেছেন। একবার ডায়নাসহ এক লেখকের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আড্ডায় আড্ডায় লেখকের পড়ার ঘর থেকে ডায়না একখানি চিঠি তুলে নেয়। সেই চিঠিখানি ভরা যৌবনে লেখককে তসলিমা নাসরিন লিখেছিলেন। চিঠিতে তসলিমা অনেক আকুতি-মিনতির মধ্য দিয়ে তাকে যখন তখন মনে করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এমনকি লেখকের মন খারাপ হলেও যেন তাকে বেশি করে মনে করেন। যদি লেখকের বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া বাধে তাহলে আরও বেশি বেশি করে মনে করার আকুতি জানিয়েছিলেন তসলিমা। ওই বাড়ি থেকে আসার পথে ডায়না বলছিল ছিঃ, এত নোংরা মেয়েমানুষ! একটা পুরুষকে নষ্ট করার জন্য কী না করতে পারে এই নারী!
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘পূর্ব-পশ্চিম’ নামের অনবদ্য এক ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস লিখে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। শুধু তাই নয়, মরমী কবি হাছন রাজাকে নিয়ে যেমন লিখেছেন কবিতা, তেমনি লালন সাঁইকে নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস ‘মনের মানুষ’। তসলিমা নোংরা, অশালীন, আক্রমণাৎদক চরিত্রহননের নির্দয় পথ সীমা অতিক্রম করেই চলেছেন। সুনীল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে এই বিখ্যাত লেখককে জানাতে চাই, আপনি বিচলিত হবেন না। অপপ্রচার চানাচুরের মতো সাময়িক মুখরোচক হয়। মানুষ আপনাকে ভালোবেসে শ্রদ্ধায় বুকে টানে। তসলিমাকে দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তসলিমা নাসরিন নামটি রসাৎদক গল্পের আড্ডার আসর মাতায়। সৃজনশীল সাহিত্য আসরে তসলিমা নাসরিন নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানেন, বাংলা ভাষী মানুষের বাড়ির বুকসেলফে তার বইগুলো গৌরবের সঙ্গে রাখা হলেও এত কাটতি পাওয়া তসলিমা নাসরিনের বই কোনো বাড়িঘরের লাইব্রেরিতে শোভা পায় না।
তসলিমা চেয়েছিলেন বিতর্ক। বিতর্ক ভোগ করেছেন জীবনভর। বিতর্কিত লেখক সালমান রুশদীর কাছেও ভিড়তে গিয়েছিলেন তসলিমা। কিন্তু রুশদী বিতর্কিত হলেও শক্তিমান লেখক। দেখলেন এ তো স্থূল নারীদেহ মাত্র। রচনার মান একেবারেই নেই। অবজ্ঞা করলেন। অপমানে হিংস জর তার দ্বারাই স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। বুড়িয়ে গেলেও কুড়িয়ে পাওয়া বিতর্ক ছাড়বেন না তসলিমা। তসলিমা বিতর্কেই থাকুন। সুনীল থাকুন মানুষের হৃদয়, চিন্তা ও কল্যাণে। ভাবনার জগৎজুড়ে। সুনীল অনেক, তসলিমা একা। গার্নার নামের যে পশ্চিমা পুরুষের বাহুলগ্না হয়েছিলেন তিনিও ভুলে গেছেন তাকে। একসময় ওপার বাংলায় যারা তসলিমার কবিতায় রং মাখাতেন তারাও আর ফিরে তাকান না। এতটাই একা তসলিমা। বাংলা সাহিত্যে তাই নন্দিত সুনীলকে নিন্দিত তসলিমা মাথা খারাপ হয়ে তেড়ে আসেন মিথ্যার ঝুলি নিয়ে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকম
মন্তব্যসমূহ