এলভেরা বা ঘৃতকুমারীর জাদুকরি সব গোপন রহস্য

——————-সেলিনা জাহান প্রিয়া —————–


অ্যালভেরা” বা ঘৃতকুমারী গাছ থাকবেই। কিন্তু আমরা কি জানি যে এই ছোট্ট গাছটির নানা ইতিহাস ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কত উপকার করে? মানব দেহের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সকল ক্ষেত্রেই অ্যালভেরার রয়েছে জাদুকরী গুনাগুণ। আসুন অজ্ঞতায় না থেকে জেনে নিই।

মিশরীয় লোককাহিনী থেকে জানা যায়, সৌন্দর্যবর্ধন করে যে প্রকৃতিকন্যা তার লাতিন নাম অ্যালোভেরা ওরফে ঘৃতকুমারী। আর এটাই হলো মিশরের টলেমি রাজবংশের সম্রাজ্ঞী, কূটনীতিক ও পরে সীজার পত্নী ক্লিওপেট্রার ত্বকের সৌন্দর্যের গোপন রহস্য। স্বাস্থ্য এবং সৌন্দর্যে অ্যালোভেরার ব্যবহার আজকের নয়। প্রাচীন কালেও রানী ক্লিওপেট্রা, সম্রাট আলেকজান্ডার, বাদশাহ সোলায়মান, নেপোলিয়ন এবং ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মত বিখ্যাত মানুষেরা অ্যালোভেরা ব্যবহার করতেন। ঘৃতকুমারী গাছটা দেখতে অনেকটাই কাঁটাওয়ালা ফণীমনসা বা ক্যাকটাসের মতো। অ্যালোভেরা ক্যাক্টাসের মত দেখতে হলেও, ক্যাক্টাস নয়। এর পাতাগুলো বর্শা আকৃতির লম্বা, পুরু ও মাংসল। তরুটির রং সবুজ যার মাঝে রয়েছে রহস্যময় গুণ যার গুণকীর্তন করে কোটি ডলার কামিয়ে নিচ্ছে পাশ্চাত্য, প্রাচ্য দেশীয় তরু থেকে। গোটা বিশ্ব জুড়ে এই গাছের জুস বা রস ক্যাপসুল বা জেলের আকারে বিক্রি হচ্ছে। এই জেলের ভেতরে আছে বিশটি অ্যামিনো অ্যাসিড যা থেকে বিজ্ঞানীরা বলেন প্রাণের সৃষ্টি। এই ২০ অ্যামিনো অ্যাসিডের আটটি দেহের মাঝে তৈরি হয় না। এটা বাইরে থেকে খাদ্যের আকারে গ্রহণ করতে হয়। এটা আসে ঘৃতকুমারী থেকে। মেছতা দূর করার আরেকটি উপাদান হলো এলোভেরা বা ঘৃতকুমারী পাতার জেল। এই জেলের রয়েছে ত্বকের যাবতীয় সমস্যা দূর করার ক্ষমতা। আক্রান্ত স্খানে আঙুলের ডগার সাহায্যে ধীরে ধীরে জেল ঘষে লাগাতে হবে এবং সারা রাত লাগিয়ে রাখতে হবে। এভাবে কয়েক সপ্তাহ লাগালে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে। এ ছাড়া অ্যালোভেরা জেলের সাথে ভিটামিন ই এবং প্রিমরোজ অয়েল মিশ্রিত করে লাগালে এক সপ্তাহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যাবে। একই সাথে জেলের শরবত খেলে ভালো হবে।অ্যালভেরাতে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, ই, ফলিক এসিড, বি ১, বি ২, বি ৩, বি ১২। প্রায় ২০ রকমের মিনারেলস যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, সোডিয়াম, আয়রন পটাসিয়াম, কপার ইত্যাদি। মানবদেহের জন্য ২২টি অ্যামিনো এসিড প্রয়োজন আর এর মধ্যে ৮ টি উপাদান থাকা অনস্বীকার্য। প্রধান ৮ টি উপাদানসহ আনুমানিক ২০ টি অ্যামিনো এসিড অ্যালভেরায় বিদ্যমান।
মানবদেহের টিস্যু নিষ্প্রাণ হয়ে গেলে, ত্বকে ফুসকুড়ি উঠলে এলভেরার জেল খুবিই উপকারী। যাদের এলার্জির সমস্যা তীব্র তারা ১ মাস নিয়মিত অ্যালভেরার শরবত খেয়ে দেখুন, জাদুকরী ফল পাবেন।
নতুন চুল গজানোর জন্য অ্যালভেরার রস নারিকেল তেলের সাথে মিশিয়ে মাথার ত্বকে ম্যাসেজ করে ৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন, সপ্তাহে ২ বার করে ২ মাস। পরিবর্তন নিজেই লক্ষ করতে পারবেন। এ ছাড়াও অ্যালভেরার রস চুল কে কন্ডিশনিং করে মোলায়েম হতে সাহায্য করে যা অনেকদিন স্থায়ী থাকে। খুশকি দূর করতে এটি প্রহরীর মত কাজ করে। এটি রক্তের কলেস্টরেল দূর করতে সাহায্য করে।
ত্বকের যত্নে
অ্যালোভেরা পাতার রস নিয়মিত ত্বকে লাগালে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে এবং রোদে পোড়াভাব দূর হয়। এটি সব ধরনের ত্বকের জন্যই উপকারী। কারণ এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। অতি সংবেদনশীল ত্বক কিংবা ব্রণ ওঠার প্রবণতা যাদের বেশি, তারা অ্যালোভেরা থেকে অনেক বেশি উপকার পাবেন। বিশেষ করে ত্বক কোমল ও মসৃণ করতে এবং ত্বকে ব্রণের দাগ দূর করতেও অ্যালোভেরার রস দারুণ কাজে দেয়। তুলো দিয়ে অ্যালোভেরার রস ত্বকে মেখে ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে নিন। কয়েকদিনের মধ্যেই তফাৎ আপনার চোখে পড়বে।

ওজন নিয়ন্ত্রণ করে
ওজন কমানোর বিষয়টি নিয়মিত জিম করার ওপর নির্ভর করে মাত্র ১০ শতাংশ। আর বাকি ৯০ শতাংশ নির্ভর করে আমরা যে খাবারগুলো খাচ্ছি তার আত্মিকরণের ওপর। প্রতিদিন সকালে ২ টেবিল চামচ অ্যালোভেরার রস পানি দিয়ে মিশিয়ে খেতে পারেন। এতে হজম শক্তি বাড়বে, পরিপাকতন্ত্র সতেজ থাকবে এবং সেই সঙ্গে দূর হবে কোষ্ঠকাঠিন্য। আর ওজনতো নিয়ন্ত্রণে থাকবেই।

চুলের যত্নে
পাতার শাঁস প্রতিদিন একবার তালুতে নিয়ম করে লাগালে মাথা ঠাণ্ডা হয়৷ অ্যালোভেরার রস মাথার তালুতে ঘষে এক ঘণ্টা রেখে ধুয়ে ফেলুন। চুল পড়া বন্ধ হবে এবং নতুন চুল গজাবে। শ্যাম্পু করার আগে আধা ঘণ্টা অ্যালোভেরার রস পুরো চুলে লাগিয়ে রাখুন। এতে চুল ঝরঝরা ও উজ্জ্বল হবে।
নিয়মিত অ্যালোভেরার শরবত খাওয়া চুলের জন্য ভালো। এতে চুল পড়া অনেকাংশে কমে যায়। খুশকি কমাতেও এটি সহায়ক। অ্যালোভেরায় আছে অ্যালোমিন নামক উপাদান, যেটি চুল লম্বা করতে সাহায্য করে।

দাঁতের যত্নে
এটা আপনার মুখের যত্ন নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অ্যালোভেরার রয়েছে বহু ঔষধি গুণাগুণ, যার মধ্যে মাড়ির সুরক্ষার গুনটিও পড়ে। অ্যালোভেরা পাতা নিয়ে এর ভেতরের জেল বের করে তা মাড়িতে ঘষে নিন এবং অ্যালোভেরার জেলটি খানিকক্ষণ মুখে রেখে দিন। তারপর মুখের ভেতরের অংশ ভাল করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এভাবে প্রতিনিয়ত করলে দেখবেন মাড়ি থেকে রক্ত পড়া একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
ঘৃতকুমারীর রস কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাসের সমস্যা দূর করতেও সাহায্য করে। ঘৃতকুমারী পাতা থেকে চামচ দিয়ে রস বের করে নিন। এরপর এই রসে কিছুটা পানি মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে খান। তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই হজমের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দুই ই দূর হয়ে যাবে ।

প্রদাহ কমায়:
ঘৃতকুমারীর রস হাড়ের সন্ধিকে সহজ করে এবং দেহে নতুন কোষ তৈরি করে। এছাড়া হাড় ও মাংশপেশির জোড়া গুলোকে শক্তিশালী করে। সেইসঙ্গে শরীরের বিভিন্ন প্রদাহ প্রশমনেও কাজ করে।

মেছতা নিরাময়ে:
আপনার যদি মেছতার সমস্যা থাকে তবে  ঘৃতকুমারী পাতার রস পানির সঙ্গে মিশিয়ে খান, প্রতিদিন দু’বার ,প্রত্যেকবার ১০ মিলিলিটার। ঘৃতকুমারীর একটি পাতা, মধু ও একটি ছোট শসা   মাস্ক করে  মেছতার ওপর লাগিয়ে রাখুন-উপকার পাবেন,এটি চামড়ার  ফুস্কুড়িও প্রতিরোধ করতে পারে ।☆নারীদের মুখে যদি মেছতা থাকে, তাহলে মেক-আপ না করা ভালো । কারণ  মেক-আপ ক্রিম ত্বকের সূক্ষ্মরন্ধ্রের স্বাভাবিক রূপান্তর বাধা দেবে এবং মুখের মেছতা গুরুতর হবে ।

হজমি সহায়ক:
নিয়মিত ঘৃতকুমারীর রস পানে হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।  । ফলে দেহের পরিপাকতন্ত্র সতেজ থাকে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।

শক্তিবর্ধক:
নিয়মিত ঘৃতকুমারীর রস সেবন শরীরের শক্তি যোগান সহ ওজনকে নিয়ন্ত্রণে  রাখতে সাহায্য করে।
রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: যারা দীর্ঘকাল ফিব্রোমিয়ালজিয়ার মতো সমস্যায় ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে ঘৃতকুমারীর রস দারুণ কাজ করে। এটি দেহে সাদা ব্লাড সেল গঠন করে যা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে।

ক্ষতিকর পদার্থের অপসারণ:
দেহ থেকে ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ঔষধির কাজ করে। আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চাপে থাকি। এছাড়া চারপাশের দূষিত পরিবেশ এবং বিভিন্ন ফাস্টফুড গ্রহণের কারণে নিয়মিত পরিপাকতন্ত্র পরিষ্কার করা দরকার। ঘৃতকুমারীর রস সেবনের ফলে শরীরে বিভিন্ন ভিটামিনের মিশ্রণ ও খনিজ পদার্থ তৈরি হয় যা আমাদেরকে চাপমুক্ত রাখতে এবং শক্তি যোগাতে সাহায্য করে।

প্রসঙ্গোচিত ঘৃতকুমারীর ব্যবহারঃ-

১। ছোটখাট দুর্ঘটনা যেমন রান্নাঘরে পোড়া বা গরম পাত্রে হঠাত হাত দেওয়া চিকিৎসায়।
২। ঘৃতকুমারী বা এলো ভেরা গোসল করার আগে শরীর ঘষে গোসল করে পেলতে পারেন, এতে শরীরের জীবাণু ধ্বংস হবে।
৩।  ঘৃতকুমারী জেল এবং ভিটামিন ই তেল মিশ্রিত করে একটি বয়ামে রাখতে পারেন যা রান্নাঘর দুর্ঘটনায় সাহায্য করবে।
৪।কালো দাগ ও কাটায় ক্ষত ধূর করতে ভাল উপকার করে।
৫। সূর্য- পোড়া ত্বকে ঘৃতকুমারী শীতল অনুভূইতি উপস্থিত মনে হবে যেমন মেন্থল অনুরূপ।
৬। পোকা/মাকড়ের কামড় বা দংশনে।
৭। ঠান্ডা উপসর্গে টিস্যু ক্ষতি কমাতে ঘৃতকুমারী ভাল উপকারী।
৮। লাল লাল র‍্যাশ/ফুসকুড়ি উপশমে

মন্তব্যসমূহ